Powered by Blogger.

Related Post

Translate

Search This Blog

টাঙ্গাইল জেলা [Tangail district]


টাঙ্গাইল জেলা বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের ঢাকা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। এর জনসংখ্যা প্রায় ৩২ লক্ষ এবং আয়তন ৩৪১৪.৩৯ বর্গ কিলোমিটার। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ অবধি এটি ছিল অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার একটি মহুকুমা। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে টাঙ্গাইল মহুকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। এটি একটি নদী বিধৌত কৃষিপ্রধান অঞ্চল।

পরিচ্ছেদসমূহ

  •  ভৌগোলিক সীমানা
  •  প্রশাসনিক এলাকাসমূহ
  •  অর্থনীতি
  •  চিত্তাকর্ষক স্থান
  •  আনুষঙ্গিক নিবন্ধ




টাঙ্গাইল জেলা
প্রশাসনিক বিভাগঢাকা
আয়তন (বর্গ কিমি)৩,৪১৪
জনসংখ্যামোট: ৩২,৫৩,৯৬১
পুরুষ:৫০.০২%
মহিলা: ৪৯.৯৮%
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা:বিশ্ববিদ্যালয়: ১
কলেজ : ৫২
মাধ্যমিক বিদ্যালয়: ৩৪৫
মাদ্রাসা : ১৭৪
শিক্ষার হার২৯.৬ %
বিশিষ্ঠ ব্যক্তিত্বআবদুল হামিদ খান ভাসানী, আবু সাঈদ চৌধুরী, রনদা প্রসাদ সাহা, শামসুল হক, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, বেগম ফজিলাতুন্নেসা, যাদু সম্রাট পি. সি. সরকার, বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দীকি, ওয়াজেদ আলী খান পন্নী, মাওলানা মকিম উদ্দিন আহমেদ।
প্রধান শস্যধান, পাট, সরিষা, গম
রপ্তানী পণ্যপাট, আনারস, কলা




ভৌগোলিক সীমানা

টাংগাইল জেলা ঢাকা হতে প্রায় একশত কি মি দূরে অবস্থিত। এই জেলার পূর্বে রয়েছে ময়মনসিংহ ও গাজীপুর, পশ্চিমে সিরাজগঞ্জ, উত্তরে জামালপুর, দক্ষিণে ঢাকা ও মানিকগঞ্জ জেলা। এর জনসংখ্যা প্রায় ৩২ লাখ এবং আয়তন ৩৪২৪.৩৮ বর্গ কি.মি.।

প্রশাসনিক এলাকাসমূহ

  • টাঙ্গাইল সদর উপজেলা,
  • কালিহাতি উপজেলা,
  • ঘাটাইল উপজেলা,
  • বাসাইল উপজেলা,
  • গোপালপুর উপজেলা,
  • মির্জাপুর উপজেলা,
  • ভুয়াপুর উপজেলা,
  • নাগরপুর উপজেলা,
  • মধুপুর উপজেলা,
  • সখিপুর উপজেলা,
  • দেলদুয়ার উপজেলা,
  • ধনবাড়ী উপজেলা।

নামকরণের ইতিহাস'
টাঙ্গাইলের নামকরণ বিষয়ে রয়েছে বহুজনশ্রুতি ও নানা মতামত। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত রেনেল তাঁর মানচিত্রে এ সম্পূর্ণ অঞ্চলকেই আটিয়া বলে দেখিয়েছেন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের আগে টাঙ্গাইল নামে কোনো স্বতন্ত্র স্থানের পরিচয় পাওয়া যায় না। টাঙ্গাইল নামটি পরিচিতি লাভ করে ১৫ নভেম্বর ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে মহকুমা সদর দপ্তর আটিয়া থেকে টাঙ্গাইলে স্থানান্তরের সময় থেকে।
টাঙ্গাইলের ইতিহাস প্রণেতা খন্দকার আব্দুর রহিম সাহেবের মতে, ইংরেজ আমলে এদেশের লোকেরা উচু শব্দের পরিবর্তে ‘টান’ শব্দই ব্যবহার করতে অভ্যস্ত ছিল বেশি। এখনো টাঙ্গাইল অঞ্চলে ‘টান’ শব্দের প্রচলন আছে। এই টানের সাথে আইল শব্দটি যুক্ত হয়ে হয়েছিল টান আইল। আর সেই টান আইলটি রূপান্তরিত হয়েছে টাঙ্গাইলে।
আরেক জনশ্রুতি মতে নীলকর টেংগু সাহেবের গল্পই সব চেয়ে বেশি প্রচলিত। বৃটিশ শাসনের প্রায় প্রারম্ভে আকুরটাকুর ও শাহবালিয়া মৌজার মধ্যবর্তী এলাকায় টেংগু সাহেবের নীল চাষ ও নীলের কারখানা ছিল। পূর্বোক্ত দুই মৌজার সীমানা বরাবর তিনি উচু মেটোপথ বা আইল যাতায়াতের জন্য তৈরী করেছিলেন। ক’জন সাধারণ এই আইল কে টেংগু সাহেবের আইল বলে উল্লেখ করতো। সুতরাং অনুমান করা হয় যে, টাঙ্গাইল শব্দটি টেংগু সাহেবের আইল নামেরই অপভ্রংশ।
আবার তরুণ গবেষক ইতিহাসবিদ, অনুবাদক জনাব খুররম হোসাইন তার ‘টাঙ্গাইলের স্থান নামঃ ইতিহাস ও কিংবদন্তী’ নামক এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন যে, সুবাদার শায়েস্তাখান সামরিক উর্দির নীচে ছিল যার অসাধারণ কুটবুদ্ধি আর প্রশাসনিক দক্ষতা। মগ আর পর্তুগীজ জলদস্যুদের দমন করা যখন কোন ক্রমেই সম্ভব হচ্ছিলো না। তখন তাঁর চিন্তায় আসে দক্ষিণ ভারতের মালাবর অঞ্চলের মোপলাদের কথা, সমুদ্র পাড়ের এই সব মোপলা, যারা অসম সাহসী যোদ্ধা, সম্মুখ যুদ্ধে যারা কখনও পিছু হটে না, সেই সব মোপলাদের নিয়ে এলেন রংরুট করে। জলদস্যুদের উৎপাত যখন কিছুটা দমিত হলো তখন তাদের বসতির স্থান নির্ধারণ করলেন বর্তমান টাঙ্গাইল শহরের পশ্চিম প্রান্তে। মোপলাদের ধর্মগুরুকে তারা নিজস্ব ভাষায় তাংগাইল বলে টাঙ্গাইল এই মোপলা সম্প্রদায় আজও টিকে আছে। এই অঞ্চলের যারা নিজেদের পরিচয় দেয় মাহিফরাস বলে। মৎস্য ব্যবসা যাদের প্রধান জীবিকা। টাঙ্গাইল অঞ্চলের লোকজন তাদেরকে নিকারি বলে জানে। পূবোল্লিখিত বিষয়গুলো বিচার করে আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি যে, মোপলাদের সর্দারকে যে স্থানে জায়গা দেয়া হয়েছিল সেই স্থানটিই ক্রমে টাঙ্গাইল নামে পরিচিত হতে থাকে।
এমতটির পেছনে রয়েছে যথেষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণাদি। ডঃ তারা চাঁদের "The influence of Islam on Indian culture"- গ্রন্থেও এ বিষয়ে সাক্ষ্য মেলে।
টাঙ্গাইলের নামকরণ নিয়ে আরো বিভিন্নজনে বিভিন্ন সময়ে নানা মত প্রকাশ করেছেন। কারো কারো মতে, বৃটিশ শাসনামলে মোগল প্রশাসন কেন্দ্র আটিয়াকে আশ্রয় করে যখন এই অঞ্চল জম-জমাট হয়ে উঠে। সে সময়ে ঘোড়ার গাড়িছিল যাতায়াতের একমাত্র বাহন, যাকে বর্তমান টাঙ্গাইলের স্থানীয় লোকেরা বলত ‘টাঙ্গা’। বর্তমান শতকের মাঝামাঝি পর্যন্তও এ অঞ্চলের টাঙ্গা গাড়ির চলাচল স্থল পথে সর্বত্র। আল শব্দটির কথা এ প্রসঙ্গে চলে আসে। বর্তমান টাঙ্গাইল অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের নামের সাথে এই আল শব্দটির যোগ লক্ষ্য করা যায়। আল শব্দটির অর্থ সম্ভবত সীমা নির্দেশক যার স্থানীয় উচ্চারণ আইল। একটি স্থানকে যে সীমানা দিয়ে বাঁধা হয় তাকেই আইল বলা হয়। টাঙ্গাওয়ালাদের বাসস্থানের সীমানাকে ‘টাঙ্গা+আইল’ এভাবে যোগ করে হয়েছে ‘টাঙ্গাইল’ এমতটি অনেকে পোষণ করেন।
ইতিহাসবিদ মুফাখখারুল ইসলামের মতে, কাগমারি পরগণার জমিদার ইনাযাতুল্লাহ খাঁ চৌধুরী (১৭০৭-১৭২৭খ্রিস্টাব্দ) লৌহজং নদীর টানের আইল দিয়া কাগমারী আধামাইল দূরে খুশনুদপুর (খুশির জায়গা যার সংস্কৃতায়ন করলে সন্তোষ) তাঁর সদর কাচারিতে যাতায়াতে করতেন। এই টানের আইল বা টান আইল বলিয়া বলে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চারিত হতে হতে টাঙ্গাইল নামকরণ হয়েছে।
অন্য মতবাদে জানা যায় ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ সরকারের আদেশ অনুযায়ী পারদীঘুলিয়া মৌজায় অন্তর্গত আতিয়া নামক গ্রামে টান-আইল থানার সদর স্থ্পন করা হয়। গত শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালীণ সময়ে টান-আইল মৌজা টাঙ্গাইল নামের রূপান্তরিত হয়।
আইল শব্দটি কৃষিজমির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই শব্দটি আঞ্চলিক ভাবে বহুল ব্যবহৃত শব্দ। টাঙ্গাইলের ভূ-প্রকৃতি অনুসারে স্বাভাবিক ভাবে এর ভূমি উঁচু এবং ঢালু। স্থানীয়ভাবে যার সমার্থক শব্দ হলো টান। তাই এই ভূমিরূপের কারণেই এ অঞ্চলকে হয়তো পূর্বে ‘টান আইল’ বলা হতো। যা পরিবর্তীত হয়ে টাঙ্গাইল হয়েছে।
অন্য একটা সূত্রে জানা যায় হযরত শাহ জামাল (রাঃ) জাহাজ যোগে এদেশে আগমন করার সময় মাদ্রাজ থেকে একদল জেলে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। এদের দলপতির নাম ‘টাংগা’। জেলেরা লৌহজং নদীর পূর্ব তীরে বসবাস শুরু করে। তাদের দলপতির নামানুসারে স্থানের নাম হয় ‘টাঙ্গাইল’।
পূর্বে টাঙ্গাইল অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চল ছিলো। এখানকার মানুষ বসবাসের জন্য মাটির উপর বাঁশ পুঁতে টং ঘর নির্মাণ করতো। টং ফরাসী শব্দ, অর্থ হলো উঁচু। অতীত সময়ে স্থানীয় অনার্য বাসিন্দারা বাসস্থানকে ‘ইল’ বলতো। তাই কারো কারো মতে এই টংইল (উঁচু বাসস্থান) থেকে টাঙ্গাইল নামের উৎপত্তি।
জনশ্রুতিতে আরো আছে যে, ব্রিটিশ আমলে নীল ব্যবসার চরম উন্নতির সময়ে বর্তমানের টাঙ্গাইল শহরে অসংখ্য টাংগা গাড়ির ভিড় লেগে থাকতো। তা থেকেই আঞ্চলিক নাম টাঙ্গাইলের উৎপত্তি।
টাঙ্গাইল জেলা গেজেটিয়ারে নামকরণ বিষয়ে সর্বাগ্রে যে তথ্যটি উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে নবাব শায়েস্তা খাঁ বাংলার সুবেদার ছিলেন। তাঁর শাসনকালে পর্তুগীজ মগ জনদস্যুদের হামলা ও অত্যাচার বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে চরমে পেঁŠছেছিলো। শায়েস্তা খাঁ পর্তুগীজ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য দাক্ষিণাত্যের মোগলদের নিয়ে এক শক্তিশালী নৌ-বাহিনী গঠণ করে ছিলেন। কালক্রমেই এই নৌ-বাহিনী ভেঙ্গে দেওয়া হলে এদের অনেকেই দক্ষিণ ভারতে মালাবাদ উপকূলে প্রত্যাবর্তন না করে লৌহজং নদীর চর এলাকায় বসতি স্থাপন করে। এসব নতুন গড়ে ওঠা বসতিগুলোকে মোগলরা অভিহিত করেছিলেন দিহ্ টাঙ্গাল (দিহ্ শব্দের ফরাসী অর্থ হলো মহল্লা) যা কালক্রমে টাঙ্গাইল হয়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ আদম শুমারী রিপোর্ট সূত্রে জানা যায় দাক্ষিণাত্যে মালাবার সমুদ্র উপকূল এলাকায় ‘মোপলা’ নামে এক জাতি বাস করত। তারা আরব বণিকদের বংশধর এবং এতদঞ্চলের মেয়েদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবব্ধ হত। মোপলাদের মধ্যে অত্যন্ত ক্ষমতাশীল ধর্মীয় নেতাদেরকে ‘তাংগাইল’ বলা হতো। এসমস্ত ধর্মীয় নেতাদের নামানুসারেই পরবর্তীকালে বর্তমান ‘টাঙ্গাইল’ নামকরণ হয়েছে।
কথিত আছে জনৈক ইংরেজ সন্তোষ জমিদারিতে ব্রিটিশ আমলে রাজস্ব আদায় করতে এসেছিলেন। রাজস্ব আদায় শেষে ঢাকা যাওয়ার পথে একদল ঠগ রাজস্বের অর্থ লুটপাট করে সেই সঙ্গে ইংরেজ সাহেবকে হত্যা করে লৌহজং এর পূর্ব পারে টাংগিয়ে রেখে যায়। সেই থেকে নাম দেওয়া হয়েছে টাঙ্গাইল।
আবার কারো করো মতে ‘টান’ এবং ‘ইল’ নামক দু’জন ইংরেজ সাহেব সন্তোষ জমিদারিতে এসেছিলেন থানার স্থান নির্বাচনের জন্য তাদের নামানুসারে নাম হয়েছে টাঙ্গাইল।
টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানের নামে ‘আইল’ শব্দের আধিক্য আছে (যেমন- বাসাইল, ঘাটাইল, ডুবাইল, নিকরাইল, রামাইল ইত্যাদি) অনেকের ধারণা টাঙ্গাইলের অন্য স্থানের নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ঘটনা প্রবাহে ‘টাঙ্গাইল’ নাম হয়েছে।
টং শব্দের ফরাসী অর্থ উঁচু। আর আইল হচ্ছে আবাদী জমির সীমানা সংলগ্ন অংশ। টাঙ্গাইল জেলা প্রাচীনকাল থেকে পাহাড়ের উঁচু ভূমি ও নিকটবর্তী কৃষি জমির সমাহার। এই উঁচু ভূমি বা টং ও জমির ‘আইল’ এই দুইয়ের সমন্বয়ের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের এলাকার নাম টাঙ্গাইল হয়েছে।


টাঙ্গাইল অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস
ইতিহাসের দৃষ্টি প্রসারিত আছে অনেক পিছনে। আমাদের বঙ্গীয় ‘ব’ দ্বীপে কবে মানব বসতি শুরু হয়েছে, কবেই বা এই নিম্নাঞ্চলে সমুদ্র গর্ভ হতে মাথাউঁচু করেছে আমরা কি তার সঠিক যুক্তিনির্ভর ইতিহাস উদ্ধারে সামর্থ হয়েছি? না হইনি। কারণ এসব বিষয়ে রয়েছে নানামত, নানাপথ।
মূলতঃ বঙ্গীয় ‘ব’ দ্বীপ তথা সমগ্র ভারত বর্ষের ইতিহাস অনেকটা অসংলগ্ন। গ্রীস, রোম ও ইংল্যান্ডের ইতিহাসের মতো সুসংগঠিত ভাবে সংরক্ষিত নয়। তবুও বিভিন্ন গবেষণা পরষ্পরায় আবিস্কৃত নিত্য নতুন তথ্যে ইতিহাস একটু হলেও ভিন্ন আলোয় প্রতিভাত হয়।
ইতিহাস পাঠে জানা যায় আজ থেকে পাঁচ, সাড়ে পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে বৃহত্তর ময়মনসিংহের অধিকাংশ অঞ্চলই সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত ছিলো। শুধু মাত্র মধুপুর ভাওয়াল বনাঞ্চল শৈল শিলার উচ্চতা নিয়ে বিরাজ করেছিলো। ধারণা করা হয় যে, সোমেশ্বরী নদীর পাড়ের গারো পাহাড় হতে ভাওয়াল গড় পর্যন্ত যে পাহাড়মালা তাই হচ্ছে বাংলাদেশের একটি প্রাচীনতম স্থলভাগ। এই স্থলভাগের বড় অংশ টাঙ্গাইল জেলার অন্তর্গত। কাজেই এ জেলার জনবসতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সু-প্রাচীন।
প্রাচীনকালে (৬২৯-৬৪৫খ্রিস্টাব্দ) পরিব্রাজক হিউ-এন্থ-সঙ্গ ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করেন। হিউ-এন্থ সঙ্গ এর ভ্রমণ কাহিনী পাঠে জানা যায় বঙ্গভূমি ছয়টি প্রধান রাজ্যে বিভক্ত ছিলো। ১। পৌন্ড্র, (উত্তর বঙ্গ, ব্রক্ষপুত্রের পশ্চিম ভাগ) ২। কামরূপ (ময়মনসিংহের পূর্বভাগসহ পূর্ববঙ্গ ও আসাম) ৩। সমতট (ঢাকা-ফরিদপুর) ৪। কমলাহু (ত্রিপুরা বা কুমিল্লা) ৫। তাম্রলিপ্ত (দক্ষিণ পশ্চিম ভাগ) ও ৬। কর্ণ সুবর্ণ (পশ্চিমবঙ্গ) উপরের বর্ণনায় প্রতীয়মান আমাদের টাঙ্গাইল জেলা তৎকালে কামরূপ রাজ্যের বা প্রাগ জ্যোতিষপুর রাজ্যাংশ- যাকে বলা হয় ‘ভাটির মুল্লুক’ এর অন্তর্গত ছিলো। মহাভারত কাব্যগ্রন্থের কামরূপ রাজ্যের সীমানা পর্যন্ত প্রসারিত বলা হয়েছে।
হিন্দু শাসন আমলে খ্রি. দশম শতাব্দীতে বাঙ্গালা সেনও পাল রাজ বংশের আবির্ভাব হয়। এই উভয় বংশের নৃপতিবর্গ বঙ্গভূমির বিভিন্ন অঞ্চল শাসন করতো। ক্রমে কামরূপ রাজ্যেও তাঁদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। জানা যায় টাঙ্গাইল অঞ্চল খ্রি. দশম হতে একাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত ১২০ বছর কাল পাল রাজেন্যবর্গ এই অঞ্চল শাসন করেছে।

এই সময়ে ময়মনসিংহর দক্ষিণ অংশ বর্তমান কাপাসিয়া, রায়পুরা ও ধামরাই নামক স্থানত্রয়ে শিশুপাল, হরিশ্চন্দ্র পাল ও যশোপাল নামক পাল বংশীয় তিনজন ক্ষুদ্র নৃপতির রাজ্য ও পশ্চিমাংশে মধুপুরে পাল রাজ ভগদত্তের ক্ষুদ্র রাজ্য অল্পে অল্পে বধিষ্ণু ছিলো। আজ পর্যন্তও ভাওয়ালের অরণ্য মধ্যে শিশুপালের বিশাল দিঘি ও বিরাট রাজধানীর ভগ্ন কঙ্কাল বর্ণনার সত্যতা প্রমাণ করছে।
মধুপুর ভগদত্তের গৃহভগ্নাবশেষে, পুষ্করিণী- ‘বারতীর্থ দিঘি, দেবলায়, মদন গোপালের বাড়ি প্রভৃতির চিহ্ন এখনও বিদ্যমান আছে। ভগদত্তের প্রতিষ্ঠিত ‘বারতীর্থ’ ক্ষেত্র এখনও প্রতিবৎসর বৈশাখ মাসে ‘মেলা’ হয়ে থাকে। প্রবাদ এই যে, রাজা ভগদত্ত স্বীয় পুণ্যশীলা জননীর আজ্ঞামতে বারতীর্থের পূণ্যোদক আনিয়া নিজ রাজধানীকে ‘বারতীর্থাশ্রম’ করে ছিলেন। সেই ‘বারতীর্থাশ্রমের’ পুণ্যনাম আজও তিরোহিত হয়নি।
এর পর দ্বাদশ শতাব্দীতে সেন বংশের নৃপতি সেনের আমলে টাঙ্গাইল জেলা সেনদের অধিকারে আসে। সেন রাজবংশের অভ্যূদয়ে এই ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো লয় প্রাপ্ত হয়ে যায়। এয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে সোনার গাঁ পতনের সময় পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ সেন রাজ্য বংশের শাসনাধীন ছিলো।
সেন সাম্রাজ্যের উপর মরণাঘাত হানেন তুর্কী আক্রমণকারী ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী। তিনি ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা লক্ষণ সেনের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী নদীয়া (বা নদীয়া) আক্রমণ করেন। বৃদ্ধ রাজা রাজধানী থেকে পালিয়ে এসে পূর্ববাংলার বিক্রমপুরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তারপর তাঁর রাজত্বকাল দু’বৎসর স্থায়ী হয় এবং তাঁর রাজ্য সীমাও খুব সংকুচিত হয়ে পড়ে। এ দু’বৎসর রাজত্বকালে বর্তমানে টাঙ্গাইল জেলার উপর তিনি তাঁর প্রভাব অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন কিনা তা’ নিশ্চিত করে বলা কঠিন। অন্যদিকে মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী তাঁর বিজয়-অভিযান পূর্বদিকে প্রসারিত না করায় এ জেলার উপর মুসলমানদের নদীয়া বিজয়ের কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। এমনকি ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ পর্যায়েও মুসলমানদের প্রভাব বা অধিকার এ জেলার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ রকম কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। সুতরাং এ জেলার এক শতাব্দীর ইতিহাস আমাদের কাছে খুবই অস্পষ্ট। কামরূপের বার ভূঁইয়াদের প্রভাব তখন এ এলাকায় বিদ্যমান ছিল বলে ঐতিহাসিকগণ অনুমান করেন। তবে এ জেলা তখন কামরূপের কোন বার ভূঁইয়ার শাসনাধীন ছিল তা আমাদের জানা নাই।
প্রথম যে মুসলিম নরপতি যিনি এ জেলার উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি হলেন গোড়াধিপতি সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ্ (দেহলভী)।
তিনি ১৩০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গৌড়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার বলেন, সম্ভবত শামসুদ্দিন ফিরোজের (দেহলভী) রাজত্ব কালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে বর্তমান কালের ময়মনসিংহ জেলার মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা। এতে প্রতীয়মান হয় যে, বর্তমান টাঙ্গাইল জেলা যা পূর্বে ময়মনসিংহ জেলার অংশ বিশেষ ছিল সেখানে মুসলমান রাজত্বের সূচনা হয় চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথমদিকে। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ ফকরুদ্দিন মুবারক শাহ বাংলার পূর্বাঞ্চল সোনার গাঁয়ে স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করেন। এ সময়ে বাংলা তৎকালীন রাজধানী গৌড়ের অধিপতি ছিলেন। ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দ শামছুউদ্দিন ইলিয়াস শাহ, আলাউদ্দিন আলী শাহকে হত্যা করে দুই বাংলা একত্রিত করে স্বাধীন রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত করেন, যা প্রায় দুই শত বৎসরকাল অর্থাৎ ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ শেরশাহ গৌড় দখলের পূর্বাপর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল। এরপর বাংলা মুগল শাসনের অন্তভূক্ত হওয়ার পূর্বপর্যন্ত প্রায় ৩৮ বৎসরকাল রাজধানী গৌড়কে কেন্দ্র করে নানা যুদ্ধ বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ ছিলো। ফলে বাংলার উত্তরাঞ্চলের এ অরাজকতাময় পরিবেশ থেকে বিশাল যমুনানদী পার হয়ে অনেক লোক চলে আসে পূর্বাঞ্চলে। পূর্ব বাংলায় তখন বার ভূঁইয়াদের রাজত্ব। অপর দিকে ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ মুগল সেনাপতি মুনিম খান, দাউদ খানকে পরাজিত করে গৌড়ের তথা বাংলার শাসনভার গ্রহণ করলে বাংলার বার ভূঁইয়াদের স্বাধীন জমিদাররা তা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। ঈশা খাঁ এ সকল বা ভূঁইয়াদের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন এবং সোনারগাঁয়ে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন।
কিংবদন্তী মতে, ঈশা খাঁ বাইশ পরগণার মালিক ছিলেন। ঈশা খাঁয়ের রাজ্যের প্রকৃত আয়তন বা চৌহদ্দির সঠিক বিবরণ প্রকৃতভাবে পাওয়া না গেলেও বাইশ পরগণার মালিকানা সম্পর্কে যে কিংবদন্তী প্রচলিত আছে সেটা সঠিক বলে মনে হয়। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সূত্র হতে ঈশা খাঁয়ের পরগণাগুলোর নাম পাওয়া যায়: কেদারনাথ মজুমদার রচিত ময়মনসিংহের ইতিহাস; জেলা গেজেটীয়ার, ময়মনসিংহ এবং পূর্ববঙ্গ গীতিকার ‘দেওয়ান ঈছা খাঁর’ পালাগানে। এসব ঘটনাবলীর সমন্বয়ে কিছু গরমিল লক্ষণীয়। এ তালিকায় আটিয়াকে একটি পরগণা হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবুল ফজলের বিবরণ থেকে জানা যায়, পুখুরিয়া, কাগমারী, আটিয়া এবং বড়বাজু পরগণার অংশ বিশেষ নিয়ে গঠিত ছিল এ সময়ের টাঙ্গাইল। বর্তমানে টাঙ্গাইল থানাধীন আটিয়া একটি ইউনিয়ন ও গ্রাম। ১৯৬১ ও ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের গ্রাম পরিসংখ্যানে স্থানটি কসবা আটিয়া বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আটিয়া পরগণার শাসক বাবা আদম শাহ্ কাশ্মিরী মৃত্যুর পূর্বে প্রিয়ভক্ত সাঈদ খাঁকে আটিয়া পরগণার শাসনভার অর্পণ করেন এবং তাঁর পরামর্শক্রমে সুবেদার ইসলাম খাঁর সুপারিশে দিল্লীর মোগল বাদশা জাহাঙ্গীর ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে সাঈদ খাঁকে আটিয়া পরগণার শাসক নিযুক্ত করেন। তবে বেঙ্গল ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারে বলা আছে সাঈদ খান পন্নী সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ) কাছ থেকে ও করটিয়ার পন্নী পরিবারের উর্ধ্বতন পুরুষ সাঈদ খান পন্নী সম্রাট আকবরের আমলে একটি জায়গার জায়গীর প্রাপ্ত হন। অন্য মতে সাঈদ খান শাহজাহান বাদশাহ (১৬২৭-১৬৫৮খ্রিস্টাব্দ) থেকে আটিয়ার শাসক নিযুক্ত হন। তবে সময় কাল যাই হোকনা কেনো সাঈদ খান পন্নীই করটিয়া জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা। ঘটনা প্রবাহে ও পারিপাশির্বকতায় সাঈদ খান ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দ আটিয়া পরগণার শাসক নিযুক্ত হয়ে ছিলেন এ কথা অধিক যুক্তি গ্রাহ্য। জায়গীরের প্রাণকেন্দ্র ছিল আটিয়া। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দ টোডরমলের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় বঙ্গদেশ ১৯ সরকার ও ৬৮২ মহাল বা পরগণাতে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে বাজুহার অধিকাংশ এলাকা নিয়ে বর্তমান ময়মনসিংহ জেলা গঠিত হয়েছে এবং এর অবশিষ্ট অংশ ঢাকা ফরিদপুর ও পাবনা জেলার অন্তর্গত। সরকার বাজুহার সীমানা পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয় আটিয়া পরগণা অধিকাংশ সময় সরকার বাজুহার অন্তর্ভূক্ত ছিল। এখানে উল্লেখ্য, টোডরমলের শাসন ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাসের সময়ই আটিয়া ও কাগমারী দু’টিকে পরগণায় পওন করা হয়।
১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ মুগল সম্রাট আকবরের মৃত্যু হলে ক্ষমতায় আসেন জাহাঙ্গীর। তিনি ইসলাম খানকে বাংলার সুবেদার করে পাঠান। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খান তার রাজধানীকে রাজমহল থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ঐতিহাসিক আবদুল করিমের মতে, ইসলাম খান মুসা খানের বিরুদ্ধে সমরাভিযান শুরু করে ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দ ১৬১১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সমগ্র পূর্বাঞ্চল মুগল শাসনাধীনে আনতে সচেষ্ট হন। অপরপক্ষে টাঙ্গাইল অঞ্চলে বিদ্যমান সর্বপ্রথম মস্জিদ স্থাপত্য (আটিয়া মস্জিদ) নিদর্শনের উল্লেখ পাওয়া যায় সপ্তদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে। শিলালিপি অনুযায়ী এটি এ অঞ্চলের বিখ্যাত পন্নী পরিবারের সাঈদ খান পন্নী নির্মাণ করেন। সমসাময়িক ইতিহাসে সাঈদ খান পন্নীর সাথে মুসা খানের কোন সম্পর্কের উল্লেখ পাওয়া যায় না। যেহেতু ইসলাম খান ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করেন ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে এবং মুসা খান অন্যান্য বার ভূঁইয়াদের শাসনাধীন অঞ্চলে মুগল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে। তাই ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দের পরে টাঙ্গাইলের করটিয়া অঞ্চলের পন্নী পরিবারের সঙ্গে ইসলাম খানের কোনই সম্পর্ক ছিল না এ কথা নির্ভূল ভাবে বলা চলে। তাঁর সময় থেকে টাঙ্গাইল জেলা বাংলার সুবাদারের অধীনে থেকে ঢাকার নায়েব নাজিম কর্তৃত্ব শাসিত হয়েছে। নবাব মুর্শিদ কুলী খান তাঁর নাত-জামাই মির্জা লুৎফুল্লাহ্কে ঢাকার নায়েব নাজিম নিযুক্ত করেন এবং তাঁর অনুমোদনক্রমে দিল্লীর তদানীন্তন বাদশাহ মির্জা লুৎফুল্লাহ্কে দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলী খান উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি তাঁর শশুর নবাব সুজাউদ্দিনের শাসনকালেও উক্ত পদে আসীন ছিলেন। নবাব সুজাউদ্দিনের সময় বিহার এবং উড়িষ্যা প্রদেশ দু’টিকে বাংলার সাথে যুক্ত করা হয়। ফলে এ বিরাট সুবা’র শাসনকার্যের সুবিধার জন্য একে চারটি ভাগে বিভক্ত করতে হয়। ঢাকা বিভাগের দায়িত্ব মির্জা লুৎফুল্লাহ্র উপর ন্যস্ত হওয়ার ফলে টাঙ্গাইল জেলাসহ সমগ্র পূর্ববাংলা, দক্ষিণ বাংলা এবং উত্তর বাংলা কিয়দংশ ঢাকার নায়েব-নাজিমের অধীনে চলে আসে। মির্জা লুৎফুল্লাহ্ ওরফে দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলী খান তাঁর এলাকায় সামগ্রিক উন্নতিকল্পে বিশেষ যত্নবান হন। কবিতা রচনায় এবং হস্তলিপিতে তাঁর রূচিবোধের পরিচয় মিলে।
দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলী খানের পর ঢাকার নায়েব-নাজিম হিসাবে নিযুক্ত হন সরফরাজ খান। তাঁর অবর্তমানে তাঁর সহকারী সৈয়দ গালিব আলী খান শাসন কার্য পরিচালনা করতেন। সরফরাজ খানের দেওয়ান হিসাবে নিযুক্ত হন যশোবন্ত রায়। যশোবন্ত রায় ছিলেন খুবই দক্ষ শাসক। ফলে ঢাকা বিভাগে শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরে আসে নবাব শায়েস্তা খানের আমলের ন্যায়। জিনিসের দাম, বিশেষ করে খাদ্য দ্রব্যের দাম উল্লেখ করার মত। এই শাসক সম্পর্কেও স্যার যদুনাথ সরকারের উক্তি প্রণিধান যোগ্য।
এর ফলস্বরূপ, উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্য এত কমে যে শায়েস্তা খানের আমলের মত আট মন চালের বিনিময় মূল্য হয়েছিল এক টাকা। সরফরাজ খানের পর ঢাকার নাজিম হন মুরাদ আলী খান। তাঁর স্বপ্লকালীন শাসনকালে বাংলার আকাশ ছিল খুবই দুর্যোগপূর্ণ। এ অবস্থার সুযোগ নিলেন নবাব আলীবর্দী খান। তিনি মুগল বাদশাহ মোহাম্মদ শাহের ফরমান বলে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে। নবাব আলীবর্দী খান মসনদে আসীন হয়ে তাঁর ভ্রাতৃস্পুত্র নাওয়াজিস মোহাম্মদকে ঢাকার নায়েব-নাজিম নিযুক্ত করেন। তাঁর সহকারী হিসাবে নিযুক্ত হন হুসেন কুলী খান।
নবাব আলীবর্দী খানের পর বাংলার মসনদে খুব অল্প সময়ের জন্য আসীন ছিলেন তাঁর পৌত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলা। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী প্রতিভূ বরার্ট ক্লাইভের হস্তে পরাজয় বরণ করলে বাংলার ইতিহাসে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা হয়। পলাশী যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী প্রথম যুগে ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে নবাব শাহ্ সুজা প্রবর্তিত ‘সরকার বাজুহার’কে তিনটি রাজস্ব অঞ্চলে ভাগ করেন- ১) জমিদারি রাজশাহী, ২) আটিয়াদিগর, ৩) জামালপুর, ঢাকা। আটিয়া দিগরের অধীনে আটিয়া, বড়বাজু ও কাগমারী পরগণা অন্তর্ভূক্ত ছিল। ঈশা খাঁর আমলে আটিয়া পরগণার সবটাই মহৎ কাজের উদ্দেশ্যে বাবা আদম কাশ্মিরীকে দান করেন। বাবা আদম কাশ্মিমীরীর মৃত্যুর পূর্বে সাঈদ খাঁ এই পরগণার বন্দোবস্ত পান। সাঈদ খাঁর পরবর্তী বংশধরগণই করটিয়ার পন্নী জমিদার এই টাঙ্গাইল অঞ্চলের সবচেয়ে প্রতাপশালী জমিদার। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ পলাশী যুদ্ধের পরই বাংলায় ব্রিটিশ রাজত্ব পরোক্ষভাবে স্থাপিত হলেও ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে এ এলাকার উপর ব্রিটিশের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
পলাশি যুদ্ধের পর ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্লাইভ, দিল্লীর বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের নিকট থেকে ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী প্রাপ্ত হ’লে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন বাংলার উপ সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকে টাঙ্গাইল জেলা ঢাকার নায়েব-নাজিমের অধীন থেকে কোম্পানীর শাসনাধীনে চলে আসে। তখন ঢাকার নায়েব-নাজিম পদের আসীন ছিলেন নবাব জাসারত খান (১৭৫৪-১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ) নবাব কাজিম আলী খান তখন বাংলার সুবাদার ছিলেন। এসময় তাঁকে কয়েক বৎসর পাটনা অবস্থান করতে হয়। ঢাকায় তাঁর অবর্তমানে কোম্পানীর পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করেছিলেন জনৈক স্কটল্যান্ডবাসী লেফ্টেনান্ট (পরে ক্যাপ্টেন) সুইন্টন।
কোম্পানীর রাজত্ব শুরু হওয়ার পর থেকে ঢাকার নায়েব-নাজিমগণের ক্ষমতা বিভাগীয় শাসকের পর্যায় থেকে আস্তে আস্তে স্থানীয় জমিদারদের ক্ষমতায় সংকুচিত হয়। ঢাকার নায়েব-নাজিমগণ ক্ষমতাশালী ছিলেন। তখন থেকে শুরু করে কোম্পানীর রাজত্বের শেষকাল পর্যন্ত স্থানীয়ভাবে যেসব জমিদার এ জেলার উপর তাঁদের প্রভাব প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁরা হলেন; করটিয়া পন্নীগণ, ও ধনবাড়ির জমিদারগণ এবং দেলদুয়ার, পাকুল্লা, নাটোরের মহারানী ভবানী ও তাঁর বংশধর, সন্তোষের মহারানী দিনমণি চৌধুরাণীর পূর্বপুরুষেরা বা এ বংশের জমিদারগণ নাগরপুর সহ স্থানীয় জমিদারগণ।
কোম্পানীর শাসনকালে শুধু প্রজা নয় খাজনা আদায়ে ব্যর্থ হলে জমিদাররাও নিগৃহীত হয়েছে।
কোম্পানীর শাসন আমলের প্রথম পর্যায়ে (১৯৬৯-৭০ ছিয়াত্তরের মন্নন্তর) সারা বাংলাদেশে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার মত এ জেলার লোকদেরকে অবর্ণীয় দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হতে হয় এবং বহু লোক খাদ্যাভাবে মৃত্যুবরণ করে। অনেকে উপায়ন্তর না দেখে দস্যূবৃত্তি অবলম্বন করে। তাঁদের অনেককেই, পরবর্তী পর্যায়ে ফকির ও সন্ন্যাসীদের কোম্পানী শাসনের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহী কার্যক্রম আমরা এ অঞ্চলে দেখতে পাই, সে কার্যক্রমে যোগদান করতে দেখা যায়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষক ও কারিগরদের বিদ্রোহ ঘটে। যার ব্যাপ্তি টাঙ্গাইল অঞ্চলে কার্যকর ছিলো সাম্প্রতিককালে ইতিহাসে এ বিদ্রোহ ‘ফকির-সন্ন্যাসী’ বিদ্রোহ নামে পরিচিত। কিন্তু এই বিদ্রোহকে তৎকালীন ইংরেজ শাসকদের লিখিত পত্রাবলী ও রিপোর্টে সন্ন্যাসীদের আক্রমণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গভর্নর জেনারেল হেস্টিংস এই বিদ্রোহকে প্রথম ‘কৃষক-বিদ্রোহ’ নামে অভিহিত করেন।
ফকির সন্ন্যাসীদের দমন ঢাকা কেন্দ্র থেকে পরিচালনের অসুবিধার জন্য ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ময়মনসিংহ কালেক্টরেট সৃষ্টি করা হয়। মিঃ রটন ছিলেন ময়মনসিংহ জেলার প্রথম কালেক্টর ম্যাজিস্ট্রেট। এ অবস্থায় আটিয়া পরগণা ব্যতীত টাঙ্গাইলের বেশী ভাগ অঞ্চল ময়মনসিংহ কালেক্টরের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। আটিয়া ঢাকা কালেক্টরের অধীনে থাকে। এ সময় যমুনা ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তনের ফলে ময়মনসিংহ জেলার সীমানার পরিবর্তন হয়েছে।
১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে যখন ময়মনসিংহ জেলা স্থাপিত হয়েছিল, তখন শ্রীহট্ট জেলার তরফ, ত্রিপুরা জেলার মেহের, সবাইল, বরদাখাত ইত্যাদি, নোয়াখালী জেলার ভেলুয়া, পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ, আসামের তুরা ইত্যাদি দূরবর্তী স্থান সমূহ ময়মনসিংহ কালেক্টরেট এর অধীনে ছিল। কাগমারী ও আটিয়া পরগণা অঞ্চলটি ময়মনসিংহ জেলার শাসনাধীনের ছিল। জেলা স্থাপনের পর ময়মনসিংহ জেলায় ৮ টি তহসিল কাচারী স্থাপন করা হয়েছিল। বর্তমান টাঙ্গাইল জেলায় তখন কাগমারী ও পুখুরিয়া পরগণায় তহসিল কাচারী স্থাপন করা হয়েছিল। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে তহসিল কাচারী বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে কাননগোর কার্যালয় স্থাপন করা হয়। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে কাননগোর পদ বিলুপ্ত করা হয়। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে বিভাগীয় কমিশনারের পদ সৃস্টি করা হয়।
১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মহকুমা ব্যবস্থা চালু করা এবং প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলাকে বিভক্ত করে জামালপুর, শেরপুর, হাজিপুর, পিংনা ও সিরাজগঞ্জ থানা সমন্বয়ে সদর মহকুমা স্থাপন করা। এই ব্যবস্থায় বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার আটিয়া থানা ঢাকা জেলায়, মধুপুর থানা ময়মনসিংহ সদর মহকুমার এবং নাসিরাবাদ, গাবতলী, মধুপুর, নেত্রকোণা, ঘোষ গাঁও, ফতেপুর, গফরগাঁও, মাদারগঞ্জ, নিকলি ও বাজিতপুর থানা সমন্বয়ে সদর মহকুমা স্থাপন করা হয়।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মপুত্রনদের গতিপথ পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে সিরাজগঞ্জ থানার কিছু অংশ পাবনা জেলার অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে সিরাজগঞ্জ থানাকে এনে ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে আটিয়া থানায় রূপান্তর করে ময়মনসিংহ কালেক্টরেটের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। টাঙ্গাইলের অধিকাংশ মৌজা তখন এই আটিয়ার অন্তর্ভূক্ত ছিল। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সরকার পারদিঘুলিয়া মৌজার অন্তর্গত আটিয়া পরগণায় টানআইল থানা পত্তন করে। যা পরে টাঙ্গাইল নামে রূপান্তরিত হয়। এরপর বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার আটিয়া থানা ঢাকা জেলায়, মধুপুর থানা ময়মনসিংহ সদর মহকুমা এবং অন্যান্য অঞ্চল জামালপুর মহকুমা অন্তর্ভূক্ত হয়।
৩ মে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে আটিয়া, পিংনা ও মধুপুর থানা সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় আটিয়া মহকুমা। ১৫ নভেম্বর ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে আটিয়া থেকে টাঙ্গাইলে মহকুমা সদর দপ্তর স্থানান্তর করা হয়। জনাব ব্রহ্মনাথ সেন ছিলেন টাঙ্গাইল মহকুমার প্রথম মহকুমা প্রশাসক। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে যমুনা নদীকে বগুড়া ও ময়মনসিংহ জেলার সীমানা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। ময়মনসিংহ জেলার ১৬৫টি গ্রামকে বগুড়া জেলার অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মপুত্রকে রংপুর ও ময়মনসিংহের এবং ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে যমুনাকে পাবনা ও ময়মনসিংহের সীমানা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিভিন্ন পরগণার নিম্নে বর্ণিত অংশসমূহ তৎকালীন টাঙ্গাইল মহকুমা অন্তর্ভূক্ত ছিল। ক) পরগণা আটিয়া, এলাকা ৭৭৯.৬৯ বর্গমাইল, মহাল- ১৪৭টি। খ) পরগণা জাফরশাহি, এলাকা ২৩২.৬৩ বর্গমাইল, মহাল- ১০টি। গ) পরগণা কাগমারি, এলাকা ৩৪৪ বর্গমাইল, মহাল- ৪৫২টি। ঘ) পরগণা কাশীপুর, এলাকা ১.৬০ বর্গমাইল, মহাল- ৬৬টি। ঙ) পরগণা পুখুরিয়া, এলাকা ৫১৫.২৫ বর্গমাইল, মহাল- ৬০৪টি। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে টাঙ্গাইল মহকুমার আয়তন ছিল ১০৪১ বর্গমাইল। তখন মহকুমায় টাঙ্গাইল, কালিহাতী ও গোপালপুর এই তিনটি থানা এবং নাগরপুর, মির্জাপুর, ঘাটাইল ও জগন্নাথগঞ্জ- এই চারটি ফাঁড়ি থানা ছিল। মধুপুর থানা তখন ময়মনসিংহ সদর মহকুমার সঙ্গে যুক্ত ছিল। পরে জগন্নাথগঞ্জ ফাঁড়ি থানাকে পাবনা এবং মধুপুর থানাকে টাঙ্গাইলের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলায় জেলাবোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়। জেলার কালেক্টর এই বোর্ডের সভাপতি মনোনীত হতেন। সদস্যগণের মধ্য হতে ১ জন সহ-সভাপতি নির্বাচিত করা হতো। সহ-সভাপতি সহ মোট ২৫ জন এই বোর্ডের সভ্য ছিলেন। তন্মধ্যে ১২ জন লোকাল বোর্ডের সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত। বাকী ১২ জন সরকার কর্তৃক মনোনীত হতেন। ময়মনসিংহ জেলা বোর্ডের আয়তন ছিল ৬২৭৮ বর্গকিলোমিটার। ময়মনসিংহ জেলা বোর্ডের অধীনে ৫ টি লোকাল বোর্ড স্থাপন করা হয়। লোকাল বোর্ড গুলো হলো- ময়মনসিংহ সদর, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও টাঙ্গাইল।
১৬ জুন ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ ও আসাম সরকারের গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নাগরপুর, মির্জাপুর, ঘাটাইল ও জগন্নাথগঞ্জ ফাঁড়ি থানাকে পূর্ণাঙ্গ থানায় রূপান্তরিত করা হয়।
ই. ভি. লেবিঞ্জ (Levinge) এর সভাপতিত্বে গঠিত Administration Commnittee এর Reprot এ পুনরায় ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহকে বিভক্ত করে ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও গোপালপুর জেলা স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়। উল্লেখ্য ধনবাড়ির জমিদার সৈয়দ নওয়াব নবাব আলী চৌধুরী গর্ভণরের নির্বাহী পরিষদ সদস্য থাকাকালীন সময়ে ময়মনসিংহ, জেলাকে বিভক্ত করাসহ ধনবাড়িতে একটা মহকুমা স্থাপনের প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। তাঁর প্রস্তাবটি অনুমোদিত হলে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ধনবাড়িতে মহকুমা স্থাপনের জন্য ৫৫.৫ একর জমি হুকুম দখল করা হয়। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলনে এই পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত হতে পারেনি।
১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের নিকট ময়মনসিংহকে বিভক্ত করে কায়েদাবাদ, নাসিরাবাদ, টাঙ্গাইল ও ইসলামাবাদ নামে ৪ টি জেলা স্থাপনের প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিল। প্রস্তাবটিতে টাঙ্গাইলে জেলা সদর স্থাপন করে টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জ মহকুমা সমন্বয়ে টাঙ্গাইল জেলার প্রতিষ্ঠাসহ গোপালপুরে পৃথক মহকুমা স্থাপনের কথা বলা হয়েছিল। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ কর্তৃক টাঙ্গাইলে একটি পৃথক জেলা স্থাপনের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। এই পরিকল্পনা অনুসরণে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ৩৪১ একর জমি হুমুক দখল করে টাঙ্গাইল জেলা সদরের নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ১ ডিসেম্বর তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানের গর্ভণর এডমিরাল এস. এম আহ্সান টাঙ্গাইল জেলার শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন। জনাব এ. এন কলিমুল্লাহ ছিল টাঙ্গাইল জেলার প্রথম জেলা প্রশাসক।
টাঙ্গাইল জেলা সৃষ্টির ইতিহাস
বর্তমান টাঙ্গাইল জেলা অতীত যমুনা নদীর বুকে নতুন জেগে ওঠা চর এলাকার সমষ্টি। এখানে ছোট্ট ছোট্ট জনগোষ্ঠী বসবাস শুরু করে যার অধিকাংশই ছিল পাশ্ববর্তী উত্তরবঙ্গের অর্থাৎ যমুনার পশ্চিম পাড়ের অধিবাসী। অতীত কাল থেকেই বহু ভাঙ্গাগড়া ও রাজনৈতিক দখল-বেদখল, চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যে এলাকা আজ টাঙ্গাইল জেলা বলে পরিচিত লাভ করেছে, টাঙ্গাইল হিসাবে তার গঠন ও স্বতন্ত্র পরিচয় ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। অর্থাৎ এই ভূমিতে জন বসতি পুরাতন হলেও টাঙ্গাইল নামটি সাম্প্রতিক। বরং এই অঞ্চল আটিয়া পরগণার অংশ হিসেবে মোগল আমল থেকে পরিচিত।
১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে কাসিম বাংলার নবাব হওয়ার পর খাজনা আদায়ের জন্য যে ভূমি বন্দোবস্ত করেন তাতে আটিয়া, কাগমারী, বড়বাজু হোসেনশাহী ইত্যাদি পরগণার নাম পাওয়া যায়- টাঙ্গাইলের নাম পাওয়া যায় না। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত রেনেলের মানচিত্রে টাঙ্গাইলের উল্লেখ নেই। পলাশী যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ক্ষমতা গ্রহণের পর এদেশে সর্বপ্রথম ভূমি জরিপ হয় ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে। সেখানেও টাঙ্গাইলের উল্লেখ নেই। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে শাসনকার্যের সুবিধার জন্য জামালপুর মহকুমা সৃষ্টি হয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলাকে দু’টি বিভাগে বিভক্ত করা হয়। ১। সদর বিভাগ, ২। জামালপুর বিভাগ। সদর বিভাগের অধীনে নাসিরাবাদ, গাবতলী, মধুপুর, নেত্রকোণা, ঘোষগাঁও, ফতেপুর, গফরগাঁও, মাদারগঞ্জ, নিকলি ও বাজিতপুর থানা সমূহ এবং জামালপুর বিভাগের অধীনে শেরপুর, হাজিগঞ্জ ও পিংনা থানা সমূহ রাখা হয়। আটিয়া পরগণার অঞ্চল সমূহ তখন ঢাকা জেলার অন্তর্ভৃক্ত ছিল। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ভূমি জরিপের সময়েও টাঙ্গাইলের উল্লেখ পাওয়া যায় না। রেনেলের মানচিত্রে আটিয়া পরগণার উল্লেখ ছিল। তখন বর্তমান টাঙ্গাইলের অধিকাংশ অঞ্চল আটিয়া পরগণার অধীনে ছিল। আঠার ও ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত আটিয়া নামে পরিচিত অঞ্চলই বর্ধিত হয়ে বর্তমান টাঙ্গাইলের রূপলাভ করেছে। এ থেকে বুঝা যায় টাঙ্গাইলের সাবেকি নাম আটিয়া বললে খুব বেশী ভূল হবে না।
১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে সরকার পারদিঘুলিয়া মৌজায় টানআইল (পরে নাম রূপান্তর হয়ে টাঙ্গাইল হয়) থানার প্রত্তন করে।
করটিয়ার মুসলিম জমিদারও বরাবর ইংরেজ বিদ্বেষী ছিল বিধায় আটিয়া পরগণাতেও নতুন থানা বা চৌকির স্থান নির্দিষ্ট হয়নি। যদিও প্রশাসনিক দিক থেকে সেটাই ছিল সর্বোত্তম। যাই হোক নতুন থানাকেই মহকুমা ঘোষণা দিয়ে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে মোমেনশাহীর সঙ্গে জুড়ে দেবার কারণটাও অনেকেই টাঙ্গাইলের স্বাতন্ত্র্যতাকে বিনষ্ট করার একটি সুক্ষ্ণ চক্রান্ত বলে মনে করেছেন। অনেকেই আবার এও মনে করেন যে, টাঙ্গাইলের শিক্ষা সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সক্রিয়তায় অংশীদারিত্ব দাবি করার একটা পরোক্ষ প্রচেষ্টা হিসেবে বিশেষ একটি গোষ্ঠি ইংরেজদের সহযোগিতায় এমনটি করিয়ে ছিলেন। মরহুম রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর তথ্য মতে তিনি কলিকাতায় ছাত্রাবস্থায় (১৯৩৬-১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ) কলিতার প্রচলিত প্রবাদ Mymensingh Distrcict minus Tangail is equeal to zero একথাই প্রমাণ করে। ঘটনা যাই ঘটে থাকুক, ময়মনসিংহ জেলায় অন্তর্ভূক্তির পর থেকেই টাঙ্গাইল বাসি নিজেদের স্বাতন্ত্র্যতা রক্ষার প্রয়োজনে টাঙ্গাইলকে ময়মনসিংহের আওতা থেকে মুক্ত করে পৃথক জেলার দাবী করে আসতে থাকেন।
১৯১২ খ্রিস্টাব্দে টাঙ্গাইলে সদর দপ্তর স্থাপন করে টাঙ্গাইল ও জামালপুর মহকুমা সমন্নয়ে পৃথক জেলা স্থাপনের খসড়া প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছিল। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ই,ভি লেভিজ (Levige) এর সভাপতিত্বে গঠিত Bengal Administrative Committee এর রিপোর্ট পুনরায় ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহকে বিভক্ত করে ময়মনসিংহ, কিশোরঞ্জ ও গোপালপুর জেলা স্থাপনের প্রস্তাব পেশ করা হয়। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলনের কারণে এই পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত হতে পারেনি।
১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ লাটের কাউন্সিলার স্যার নওয়াব আলী চৌধুরীর নেতৃত্বে ও তৎকালীন রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুল হালিম গজনবীর মিলিত প্রচেষ্টায় টাঙ্গাইলকে পৃথক জেলা করার দাবী প্রত্থাপিত হয়। প্রশাসনিক কারণে ময়মনসিংহ জেলা ভাগ করার লক্ষে তৎকালীন ইংরেজ সরকার রাউল্যান্ড কমিটি গঠন করে। এই কমিটির সুপারিশক্রমে ভারতে বড় লার্ট লড রোনাগোসে ময়মনসিংহ জেলাকে ভেঙ্গে জামালপুরের জেলা সদর ও ধনবাড়িতে মহকুমা স্থাপনের অনুমোদন দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে পরিকল্পনা কার্যকর হয়নি বহুবিধ কারণেই। টাঙ্গাইল মহকুমা সদরে নতুন টাঙ্গাইল জেলা স্থাপনের দাবী অব্যহত ভাবে চলতেই থাকে।
খন্দকার আবদুর রহিম টাঙ্গাইলের ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন; ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলা স্থাপিত হয়েছিল। বর্তমানে টাঙ্গাইল যে মোমেনশাহী জেলার অন্তর্গত ছিল। সেই মোমেনশাহী পূর্বেছিলো কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত। গৌড়ের সন্তান হোসেনশাহ (১৪৯৩-১৫১৮ খ্রিস্টাব্দ) কামরূপ রাজ্য অধিকার করেন এবং বর্তমান মোমেনশাহী অঞ্চলটি কামরূপ থেকে আলাদা করে স্বীয়পূত্র নসরত শাহকে আধিপত্য দান করেন।
টাঙ্গাইল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করার জন্য বহু সংগ্রাম করতে হয়েছে। এই প্রচেষ্টা বৃটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমলের শেষ পর্যায় ছিলো। অবিভক্ত বঙ্গদেশে ময়মনসিংহ জেলা ছিল সবচেয়ে বড় জেলা। ময়মনসিংহে থেকে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল শাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা ছিলো কঠিন কাজ। তাই স্বভাবত কারণেই টাঙ্গাইল মহকুমাকে জেলা উন্নীত করার বার বার দাবী উঠছে। প্রশাসনের কাছ থেকে আশ্বাস পাওয়ার পরও টাঙ্গাইল জেলায় উন্নীত হতে পারেনি। কারণ যখনই জেলা প্রতিষ্ঠান দাবী তোলা হয়েছে তখনই রাজনৈতিক কারণে তা বাস্তবায়িত হতে পারেনি।
একদা ময়মনসিংহ জেলাই টাঙ্গাইল অঞ্চলের গোপালপুর থানার সূবর্ণ খালীতে স্থানান্তর হতে চেয়েছিল। কারণ সূবর্ণখালী সেই সময়ে ময়মনসিংহ জেলার স্বাস্থ্যকর স্থান ছিল। সুর্বণখালী যে তখন স্বাস্থ্যকর স্থান ছিল তার বিবরণ কিছুটা পাওয়া যায় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের প্রকাশিত ময়মনসিংহ গেজেটিয়ারে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে বাঁচার জন্য ময়মনসিংহের তৎকালীন সিভিল সার্জন ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলা সদর সুর্বণখালীতে স্থানান্তরের পরমর্শ রেখেছিলেন। সরকারের নিকট গেজেটিয়ারে উল্লেখ আছে - The towns of Maymenshingh are not sufficient impertinence to merit special attention in this chapter. In 1869 civil surgeon recommended the transfer of the head quarters of the district to Seaborne Khaki or Jamalpur.
১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে Sir Andrew Fraser ময়মনসিংহ জেলা বিভক্ত করে পৃথক জেলা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আবার আলোচনায় নিয়ে আসেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গ ভঙ্গ হলেও বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলতে থাকে। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব বঙ্গ ও আসাম সরকার এক প্রজ্ঞাপণের মাধ্যমে ময়মনসিংহ জেলা সদরের দুই প্রান্তে পৃথক দু’টি জেলা সদর স্থাপন করে ময়মনসিংহকে দ’ুটি পৃথক জেলায় রূপান্তর করার বিষয়ে জনমত জরিপের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রস্তাবটি বিরোধিতার সম্মুখীন হলে টাঙ্গাইল জামালপুর মহকুমা নিয়ে পৃথক একটি জেলা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ পূর্বক জনমত জরিপের ব্যবস্থা করেন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে এ বিষয়ে ময়মনসিংহ জেলা শহরে একটি বড় জনসভাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
ধনবাড়ির অনারেবল নবাব স্যার নওয়ার আলী চৌধুরী সি.আই.ই সাহেব ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে টাঙ্গাইল মহকুমার কতিপয় জমিদার ও বিশিষ্ট ব্যাক্তিকে নিয়ে ধনবাড়িতে এক সভার আঞ্জাম করেছিলেন। সেই সভাতেই প্রথম সুবৃহৎ মোমেনশাহী জেলাকে বিভক্ত করার দাবী উত্থাপিত হয়েছিল। অনারেবল নবাব স্যার নওয়াব আলী চৌধুরী সাহেব ছিলেন ইংরেজ লাট সাহেবের কাউন্সিলর। তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়ে ছিলেন প্রভাবশালী জমিদার স্যার আবদুল হালীম গজনবী সাহেব। তিনি ছিলেন রেলওয়ের বোর্ডের সদস্য। তাদের মিলিত প্রচেষ্টায় সমগ্র টাঙ্গাইল মহকুমা ও জামালপুর মহকুমার কিয়দংশ নিয়ে একটা স্বতন্ত্র জেলা প্রতিষ্ঠার দাবী পেশ করা হয়েছিল। দাবী করা হয়েছিল প্রস্তাবিত জেলার সদর স্থাপনের জন্য ধনবাড়িকে মনোনীত করা হোক। কেবল তাই নয় ধনবাড়ি হয়ে টুঙ্গি-টাঙ্গাইল-জামালপুর একটা নতুন রেল পথ স্থাপনেরও পরিকল্পনা পেশ করা হয়েছিল ইংরেজ সরকারের কাছে।
ময়মনসিংহ জেলা বিভক্তি করণের বিষয়টি সাধারণ জনগণের মনে তেমন প্রক্রিয়া সৃষ্টি করেনি এবং আগ্রহও দেখায়নি। কারণ জনগণ থেকে প্রশাসন ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার অবস্থান ছিল অনেক দূরত্বে। তারা প্রশাসনিক সুযোগ সুবিধা থেকেও বরাবর বঞ্চিত ছিল। প্রস্তাবনার পক্ষে বা বিপক্ষে তাদের তেমন অবন্থান ছিল না।
তবে শিক্ষিত সুধিমহল বিশেষতঃ উকিল, মোক্তার, ব্যবসায়ী, জমিদার, উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পেশাজীবি লোকজন জেলা বিভাজনের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত স্বার্থ জরিত থাকার কারণে তারা ময়মনসিংহ জেলা সদরের বাইরে অন্য কোথায়ও জেলা সদর স্থাপনের বিরোধিতা করেছেন। প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ আছে- The protests appeared to come almost entirely from the pleader class. These are supported by the numerous classes of touts, hotel keepers and other persons nourished by litigation. A small number of zaminders, whose house were in Mayenshing and lands in some outlying part of the district, were also very naturally impressed by the inconvenience that would be caused to them selves. This person also put for word the argument, which appealed to a winder section- That the importance of the district ant of it’s local bodies, official & non official, would be diminished, while such head quarters institutions as schools, colleges, water, works, dispensaries & like would suffer...
বাংলার বিভিন্ন জেলা সমূহে বিদ্যমান অসুবিধা ও জটিল পরিস্থিতি যাচাই করার জন্য সরকার ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অক্টোবর ৬ সদস্য বিশিষ্ট Bengal District Administration committee গঠন করেন। কমিটির মেয়াদকাল ছিল ১৯১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দ। মিঃ ই.ভি লিভিঞ্জ ছিলেন কমিটির সভাপতি এবং সদস্য সচিব ছিলেন মিঃ সি.ই.লো। কমিটির সম্মানিত সদস্য ছিলেন মিঃ এইচ. ভি. লোভেট, মিঃ এন.ডি বিটসন বেল, মিঃ কে.সি.দে এবং মিঃ ই.এন. ব্লান্ডি। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর তারিখে কমিটি কাজ শুরু করেন। উক্ত কমিটি সরকারের বিভিন্ন দলিল দস্তাবেজ, বিগত কমিটি সমূহের রিপোর্ট পর্যালোচনার পাশা পাশি বিভিন্ন জেলায় সরোজমিনে পরিদর্শণ ও সুধিমহলের সঙ্গে মত বিনিময়ের মাধ্যমে প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করে নিজস্ব সুপারিশ বা প্রস্তাবনা সরকারের নিকট পেশ করেন। তাদের সুপারিশ মালায় ময়মনসিংহ জেলা বিভিক্ত করে তিনটি পৃথক জেলা প্রতিষ্ঠা (ময়মনসিংহ, গোপালপুর ও কিশোরগঞ্জ) এবং বিদ্যমান পাঁচটি মহকুমার স্থলে নয়টি মহকুমার স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল।
প্রস্তাবিত গোপালপুর জেলার রূপরেখা ও কাঠামোঃ নালিতাবাড়ি থানা ব্যতীত সমগ্র জামালপুর এবং টাঙ্গাইল মহকুমা নিয়ে প্রস্তাবিত গোপালপুর জেলা গঠিত হবে। জেলা সদরের জন্য স্থান নির্বাচন প্রসঙ্গে টাঙ্গাইল ও জামালপুর শহরের অধিবাসীদের মধ্যে উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠা বিরাজমান ছিল। উভয়ের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও ছিল লক্ষনীও। জামালপুর ও টাঙ্গাইলের মধ্যে টাঙ্গাইল মহকুমা ছিল বড় ও গুরুত্বপূর্ণ। তবে টাঙ্গাইল সদর শহর ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। টাঙ্গাইল অথবা জামালপুর শহরের যে কোন একটিকে প্রস্তাবিত জেলা হিসেবে বেছে নিলে তা জেলার একপ্রান্তে অবস্থিত থাকবে। সেজন্য প্রশাসনিক যে অসুবিধা দেখা দিবে তা মোকাবেলার জন্য আবারও নতুন মহকুমা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিবে। এসমস্ত অসুবিধা ও প্রতিবন্ধকতার কথা বিবেচনা করে কমিটি টাঙ্গাইল ও জামালপুর জেলার মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত গোপালপুর থানাতে জেলা সদর স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রস্তাবিত জামালপুর-টাঙ্গাইল এবং সুর্বণখালী-ময়মনসিংহের রেলপথের সংযোগস্থলের নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকর একটি জায়গাতে জেলা সদর নির্মাণের স্থান বাছাই করা হয়।
প্রস্তাবিত গোপালপুর জেলায় মহকুমা ছিল তিনটিঃ ক) সদর মহকুমা, খ) জামালপুর মহকুমা, গ) টাঙ্গাইল মহকুমা।
ক) সদর মহকুমাঃ সরিষাবাড়ি, গোপালপুর, কালিহাতী ও ঘাটাইল থানা নিয়ে গঠিত। এর আয়তন ৬১৬ বর্গমাইল। লোক সংখ্যা ৫৫৪৩১৫ জন। গ্রাম- ৮৯টি। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে উল্লেখিত থানা সমূহে পুলিশ কেসের সংখ্যা ছিল ৬৬১টি।
খ) জামালপুর মহকুমাঃ জামালপুর-মেলান্দ, শেরপুর, দেওয়ানগঞ্জ ও মাদারগঞ্জ থানা সমন্বয়ে গঠিত। এর আয়তন ৯৪৮ বর্গ মাইল। লোক সংখ্যা ৬৮৮৭৫৩ জন। গ্রাম- ৯৬টি। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে থানা সমূহে নথিভূক্ত পুলিশ কেস ছিল ৬৫২টি।
গ) টাঙ্গাইল মহকুমাঃ টাঙ্গাইল, বাসাইল, মির্জাপুর ও নাগরপুর থানা সমন্বয়ে গঠিত। এর আয়তন ৪৪৬ বর্গ মাইল। লোক সংখ্যা ৪৯৫৪৫৭ জন। গ্রাম- ৮৭ টি। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে এসব থানায় পুলিশ কেস ছিল ৬৭১টি।
প্রস্তাবিত গোপালপুর জেলায় মোট থানার সংখ্যা ১৩টি, জনসংখ্যা ১৭৩৮৫২৫ জন। আয়তন ২০০৯ বর্গ মাইল। মোট গ্রাম- ২৭২ এবং ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে মোট পুলিশ কেসের সংখ্যা ছিল ১৯৮৪ টি। প্রস্তাবিত জেলার প্রশাসন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য সরকারী কর্মকর্তা (Civil Executive Staff) ছিল নিম্নরূপঃ
১। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটঃ ০১ জন। ২। মহকুমা প্রশাসকঃ ০১ জন করে প্রতি মহকুমায়। ৩। প্রথম শ্রেণীর ক্ষমতা সম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট ০২ জন (জেলা সদরের জন্য)। ৪। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও সাব ডেপুটি ম্যাজিস্টেট (২য় শ্রেণী/৩য় শ্রেণীর ক্ষমতা সম্পন্ন) জেলা সদরের জন্য। ৫। টাঙ্গাইল ও জামালপুর মহকুমার জন্য ২য় শ্রেণী ক্ষমতা সম্পন্ন ২ জন করে সাব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ১৯১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে Bengal District Administration Committee টাঙ্গাইল ও জামালপুর, সদর মহকুমা সমন্বয়ে প্রস্তাবিত ‘গোপালপুর জেলার’ রূপরেখা ও কাঠামো চুড়ান্ত করার পাশাপাশি জেলা ও মহকুমা সমূহের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতি নজর রেখেছিলেন। কারণ জলাভূমি, নদ-নদী, উপনদী, খালবিল নালার কারণে তৎকালীন স্থল যোগাযোগ ব্যবস্থা সন্তোষজনক ছিল না। এলাকার উন্নয়ন ও গতিশীল প্রশাসনের জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা অপরিহার্য এজন্য কমিটি টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ-সিংঝানি এবং যমুনা নদী তীরবর্তী বিখ্যাত বন্দরনগরী সুবর্ণাখালী হতে ময়মনসিংহ, ভৈরব বাজার হতে কিশোরগঞ্জ হয়ে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও ধারানগিরি কয়লা খনি পর্যন্ত নতুন রেলপথ স্থাপনেরও সুপারিশ করেছিলেন।

প্রস্তাবিত গোপালপুর জেলা বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে বৃটেন প্রথম মহাযুদ্ধে জড়িয়ে পরে। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল উত্তপ্ত। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিশ্বযুদ্ধ এবং ভারতীয় উপমহাদেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই তৎকালীন বৃটিশ সরকার মিঃ ই.ভি.লিভিঞ্জ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে উৎসাহী হয়নি। পরবর্তী কালে জেলা বিভাজন ও নতুন জেলা সৃষ্টির প্রস্তাব ও পরিকল্পনা সরকারী ও স্থানীয় ভাবে একাধিকবার আলোচনায় এসেছে। কিন্তু প্রস্তাবিত ‘গোপালপুর জেলার’ কথা রহস্যজনক কারণে অন্ধকারেই থেকে গেছে।
প্রস্তাবিত ‘গোপালপুর জেলা’ বাস্তবায়িত হলে ময়মনসিংহ জেলার সমগ্র পশ্চিম অঞ্চলের জনগণ অধিক লাভবান হতো। টাঙ্গাইল ও জামালপুর জেলার অবস্থান উত্তর-দক্ষিণ লম্বালম্বি। দু’প্রান্তে দু’টি মহকুমা সদর ও মাঝখানে জেলা সদর প্রতিষ্ঠিত হলে সমগ্র অঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রাস্তা-ঘাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা ও শিক্ষা-সংস্কৃতির ব্যাপক প্রকাশ ঘটতো প্রায় শতবর্ষ পূর্বেই।
মিঃ ই.ভি.লিভিঞ্জ কমিটির (১৯১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দের) প্রস্তাবিত গোপালপুর জেলা এখন স্থানীয় আঞ্চলিক ইতিহাসে উপাত্ত মাত্র।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে খেলাফত আন্দোলন শুরু হয়। মওলালা মুহম্মদ আলী ও মওলানা শওকত আলী এই আন্দোলনকে মহাত্নাগান্ধী সমর্থন করেন। ফলে আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের খেলাফত আন্দোলন বৃটিশ সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। খেলাফত আন্দোলনের জন্য টাঙ্গাইলকে জেলা করার পরিকল্পনা স্থগিত হয়ে যায়।
১৯৩৮, ১৯৪৩,১৯৪৮,১৯৫৪ ও ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্রাদেশিক সরকারের বিভিন্ন মূখ্যমন্ত্রী ও বিভাগীয় মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে যুক্তিক দাবী দাওয়া উত্থাপন ও সরকারী পর্যায়ে সমর্থিত হবার এক পর্যায়ে ১৯৬০,১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান অর্থনৈতিক কাউন্সিল মোমেনশাহীকে ভেঙ্গে টাঙ্গাইল, কাইদাবাদ ও নাসিরাবাদ জেলা করার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে।
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই সময় বাংলার দুই তৃতীয়াংশ লোক অনাহারে মারা যায়। মানুষ কচু ঘেচু নানারকম অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে অকালে প্রাণ ত্যাগ করতে থাকে। ইংরেজ সরকার কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ রোধ করার জন্য চেষ্টা করেন। বাংলার বাইরে থেকে খাদ্যশস্য এনে জেলাওয়ারী খাদ্যশস্য বণ্টন করে দুর্ভিক্ষ রোধ করার চেষ্টা করা হয়। এই সময় অবিভক্ত বাংলার খাদ্য মন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব।
টাঙ্গাইলের লোকজন টাঙ্গাইলের জন্য আরো খাদ্য শস্য বরাদ্দের জন্য খাদ্য মন্ত্রীর নিকট দাবি জানায়। শহীদ সাহেব সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই টাঙ্গাইলকে আলাদা একটি জেলায় উন্নীত করার প্রস্তাব করেন।
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন টাঙ্গাইল থেকে উপ-নির্বাচনের প্রার্থী হয়েছিলেন। সে সময় মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অছিয়তে তরুণ অগ্নিবর্ষী নেতা শামছুল হকের নেতৃত্বে টাঙ্গাইলবাসী ১৭ দফা দাবি সম্বলিত এক স্মারক লিপি পেশ করেছিলেন। খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে। সেই ১৭ দফার মধ্যে প্রধান ছিল টাঙ্গাইলকে পৃথক জেলায় পরিণত করার দাবী।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট র‌্যাডক্লিফ সীমানা কমিশন বাংলাকে দু’টি ভাগে বিভক্ত করে। ফলে পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশের কিছু জেলার সীমানা পরিবর্তন ঘটে। তবে ময়মনসিংহ জেলার সীমানা আগের মত বহাল রাখা হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে উপ-মহাদেশ বিভক্তের পর ময়মনসিংহ জেলাকে ৩ টি জেলায় ভাগ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রস্তাবিত জেলাগুলোর নাম হলো- নাসিরাবাদ, কায়দাবাদ ও টাঙ্গাইল। এমনকি ময়মনসিংহ জেলার ৫টি মহকুমাকে ৫টি জেলায় বিভক্ত করার প্রস্তাবও করা হয়েছিল।
১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের পাক-ভারত যুদ্ধের কারণে জেলা স্থাপনের কাজ স্থগিত হওয়ার সুযোগে ১৯৬৬,১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ তৎকালীন গভর্ণর মোনায়েম খাঁর ভাই খোরশেদ খান সাহেব এক শ্রেণীর কায়েমী স্বার্থন্বেষীদের যোগসাহসে গভর্ণরের আর্শিবাদ পুষ্ট হয়ে জুট মিলে বিনিময়ে জেলার দাবী প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেন। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে প্রচন্ড রাজনৈতি অস্থিরতা ও সামনে সাধারণ নির্বাচন বিধায় কোনো রাজনৈতিক দলই তখন এদিকটায় তেমন উৎসাহ প্রদর্শন না করার কারণে অবশেষে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ কর্তৃক স্থাপ্তিত টাঙ্গাইল মাহ্ফিল (স্থাপিত ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ) কর্তৃক অরাজনৈতিক ভাবে জেলা প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে সোচ্চার হতে হয় এবং ‘টাঙ্গাইল জেলা চাই’ নামে আন্দোলন শুরু করা হয়। মাহ্ফিলে সভাপতি ড. আলীম আল রাজির নেতৃত্বে। এই আন্দোলনে মাহফিলকে ড. এম.এন হুদা (সাবেক অর্থমন্ত্রী) তাঁর সরকারী সুবিধা ব্যবহার করে এন.ইসি’র অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি সরবরাহ করে সর্বাত্নক সহযোগিতা দান করেন। টাঙ্গাইলের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ টাঙ্গাইল থেকে সবিশেষ সক্রিয়তা প্রকাশ করেন।
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব-পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন উপলক্ষে হক-ভাসানী- সোহরাওয়ার্দী যুক্তফ্রন্ট গঠণ করেন। এই সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগ সূচনীয় ভাবে পরাজিত হয়। যুক্তফ্রন্টের কাছে টাঙ্গাইল বাসী টাঙ্গাইলকে পৃথক জেলা ঘোষণা করার দাবি জানায়। যুক্তফ্রন্ট তা নির্বাচনী ওয়াদা হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করে। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করে। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী ওয়াদা হিসেবে টাঙ্গাইলকে পৃথক জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু করে। এ ব্যাপারে মওলানা ভাসানীর সক্রিয় সমর্থন ছিল। এইভাবে বিভিন্ন সময়ে দাবির প্রেক্ষিতে টাঙ্গাইল মহকুমা প্রতিষ্ঠার একশত বৎসর পর অর্থাৎ ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১ডিসেম্বর টাঙ্গাইল মহকুমা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৯তম জেলা হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে।

অর্থনীতি

চিত্তাকর্ষক স্থান

আতিয়া মসজিদ, কুমুদিনী হাসপাতাল, সন্তোষ জমিদার বাড়ী, করটিয়া জমিদার বাড়ী।v



তথ্যসূত্র

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে





































 
Copyright 2009 বাংলাদেশ
Design by BloggerThemes