সাতক্ষীরা জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল।
পরিচ্ছেদসমূহ
|
প্রশাসনিক বিভাগ | খুলনা |
আয়তন (বর্গ কিমি) | ৩,৮৫৮।৩৩ |
জনসংখ্যা | মোট : ১৮,৪৩,১৯৪ পুরুষ:৫০.৫৪% মহিলা: ৪৯.৪৬% |
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা: | বিশ্ববিদ্যালয়: ০ কলেজ : ৩৯ মাধ্যমিক বিদ্যালয়: ২২১ মাদ্রাসা : ২৫৯ |
শিক্ষার হার | ৩০.৩ %
সাক্ষরতার হার ৪৫.৫%
পুরুষ সাক্ষরতার হার ৫১.৮৪%
মহিলা সাক্ষরতার হার ৩৮.৯১%
|
বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব | সিকান্দর আবু জাফর, কবি আহসান হাবীব, খানবাহাদুর আহসানউল্লাহ, তোফাজ্জল হোসেন মানিক, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী |
প্রধান শস্য | ধান, পাট, আখ |
রপ্তানী পণ্য | ধান, পাট, আলু |
ভৌগোলিক সীমানা
সাতক্ষীরা জেলার উত্তরে যশোর জেলা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে খুলনা জেলা এবং পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য অবস্থিত। অবস্থানগত দিক দিয়ে দেখলে সাতক্ষীরা জেলার অবস্থান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে। জেলার উত্তর গোলার্ধে নিরক্ষ রেখা এবং কর্কটক্রান্তি রেখার মধ্যবর্তী ২১°৩৬´ থেকে ২১°৫৪´ উত্তর অক্ষাংশে এবং ৮৮°৫৪´ থেকে ৮৯°২০´ দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। উচ্চতার দিকে বিবেচনা করলে এ অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক ১৬ ফুট উচুঁতে। জেলার সীমানা যেভাবে নির্ধারিত হয়েছে তাতে উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ। বর্তমানে এ জেলার আয়তন ৩৮৫৮.৩৩ বর্গ কিলোমিটার। তবে এ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সব অংশে জনবসতি নেই। এর মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ বনাঞ্চল। সুন্দরবনের মধ্যে যে পরিমাণ ভূমি তার পরমাণ ১৪৪৫.১৮ বর্গ কিলোমিটার। ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক দিয়ে তাকালে এ জেলার পূর্বে খুলনা জেলা, পশ্চিমে চব্বিশ পরগণা জেলার (ভারত) বসিরহাট মহকুমা, উত্তরে যশোর জেলা ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।
প্রশাসনিক এলাকাসমূহ
সাতক্ষীরা জেলার উপজেলা গুলো হলো:
- আশাশুনি উপজেলা
- কলারোয়া উপজেলা
- কালীগঞ্জ উপজেলা (সাতক্ষীরা)
- তালা উপজেলা
- দেবহাটা উপজেলা
- শ্যামনগর উপজেলা
- সাতক্ষীরা সদর উপজেলা
ইতিহাস
সাতক্ষীরা জেলার আদি নাম সাতঘরিয়া। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় বিষ্ণুরাম চক্রবর্তী, নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কর্মচারী হিসেবে ১৭৭২ সালে নিলামে পরগনা কিনে গ্রাম স্থাপন করেন। তাঁর পুত্র প্রাণনাথ চক্রবর্তী সাতঘর কুলীন ব্রাহ্মণ এনে এই পরগণায় প্রতিষ্ঠিত করেন এবং নাম হয় সাতঘরিয়া। ১৭৮১ সালে বর্তমান যশোর, ফরিদপুর, সাতক্ষীরা, খুলনার বৃহত্তর অংশ একই জেলা হিসেবে আসে । এক অনির্বচনীয় নান্দনিক অনুভবের প্রাচীন জনপদ সাতক্ষীরা একদা রাজা প্রতাপাদিত্যের যশোহর রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। বারোভূঁইয়াদের অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী এ জেলার কালিগঞ্জ ও শ্যামনগর এলাকায়। বাংলাদেশের মানচিত্রে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সাতক্ষীরা জেলার অবস্থান। এ জনবসতি প্রাচীনকালে খ্যাত ছিল বুড়ন দ্বীপ নামে। এর পাশে চন্দ্রদ্বীপ, মধুদ্বীপ, সূর্যদ্বীপ, সঙ্গদ্বীপ, জয়দ্বীপ ইত্যাদি দ্বীপ খ্যাত ছোট ছোট ভূখণ্ডের অবস্থান পাওয়া যায় প্রাচীন ইতিহাস ও মানচিত্রে। ঠিক কোন সময় থেকে বুড়ন দ্বীপে সমাজবদ্ধভাবে মানুষের বসবাস শুরু হয় তার বিস্তারিত ও সঠিক তথ্য প্রমাণাদি পাওয়া যায় না। রামায়ণ মহাভারতের তথ্যানুযায়ী এ অঞ্চলের সংঘবদ্ধ মনুষ্য বাসতির গোড়াপত্তন প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্ব থেকে। মহাভারতের তথ্যানুযায়ী মুনি কপিল পাইকগাছার কপিলমনিতে একটি কালিমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে পূজা দেন। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা এবং পূজা দেওয়ার কাজটা তিনি করেছিলেন মহাভারতের যুগে। আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ সনে। তাঁর ভারত আক্রমণের সময় গঙ্গার মোহনায় গঙ্গারিডি নামের একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্তমান সাতক্ষীরা জেলাটি ছিল এ রাষ্ট্রের অধীন। আলেকজান্ডারের পর মৌর্য ও গুপ্ত যুগে বুড়নদ্বীপ ছিল পুণ্ড্রভুক্তির অন্তর্গত। বুড়নদ্বীপ এ সমেয় পরিচিত ছিল খাড়িমণ্ডল নামে। চন্দ্র বর্মণ খাড়ি অঞ্চল দখল করেনেন চতুর্থ শতকে। এর পর বৌণ্যগুপ্ত (৫০৭-৫২৫) দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার স্বাধীন নরপতি হিসেবে রাজ্য শাসন করেন। সপ্তম শতকে শশাঙ্ক, ভদ্রবংশ, খরগোরাত ও লোকনাথ বংশ রাজত্ব করছিলেন এ জনপদে। রাজা শশাংক ছিলেন ইতিহাস খ্যাত নরপতি। This district most probably came under the authority of Sasanka, the ruler of Gauda, in to beginning of the 7th century A.D. Sasanka occupies a prominent place in the history of Bengal, as he is the first king of Bengal who extended his suzerainty over territories bar beyond the geographical limits of the territories of Bengal. সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে খুব সম্ভবত অত্র জেলা গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের কর্তৃত্বাধীনে আসে। বাংলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন শশাঙ্ক। তিনিই বাংলার প্রথম শাসনকর্তা যিনি শুধু বাংলা নয় বরং বাংলার ভৌগোলিক সীমারেখার বাইরেও বহুদূর পর্যন্ত তাঁর সার্বভৌমত্ব বিস্তৃত করেছিলেন। রাজা শশাঙ্ক নিজে রাজ্যকে শুধু ভৌগোলিক অবস্থানে সুদৃঢ় করে ক্ষান্ত থাকেননি। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে বেশ কয়েকটি রাজ্য দখল করেন ও বৃদ্ধি করেন নিজ রাজ্যের সীমানা। পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ (খ্রিঃ ৬৩৪) যে ভ্রমণ বৃত্তান্ত দিয়েছেন তাতে গঙ্গারিডি রাজ্যের উল্লেখ পওয়া যায়। এর সময়ের গঙ্গারিডি পুণ্ড্রবর্ধন, কর্ণসুবর্ণ, কজংগল, তাম্রলিপ্তি, সমতট প্রভৃতি নামে খ্যাত ছিল। ‘বর্তমানের সাতক্ষীরা জেলা এই সমতটেরই অংশ’।
অষ্টম থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় পাল ও বর্মণ রাজারা শাসন করেন বুড়নদ্বীপ। তাঁদের আমলে সভ্যতা, সংস্কৃতির শ্রীবৃদ্ধি ইতিহাস খ্যাতি লাভ করেছে বৌদ্ধ ইতিহাস ও বৌদ্ধ সংস্কৃতি নামে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী পাল আমলে দশম শতকে দক্ষিণ পূর্ব বাংলায় স্বাধীন রাজা ছিলেন চন্দ্র বংশের রাজা ত্রৈলক্য চন্দ্র ও শ্রী চন্দ্র (৯৩০-৯৫৭)। চন্দ্র রাজের সময় দক্ষিণ বঙ্গ ছিল সমৃদ্ধ জনপদ। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চন্দ্রবংশের নৃপতিরা বেশ কিছুকাল জনপ্রিয় শাসক ছিলেন এ জনপদে। শ্রী চন্দ্রের পর কল্যাণ চন্দ্র (৯৭৫-১০০৩ খ্রিঃ), লড়হচন্দ্র (১০০০-১০২০ খ্রিঃ), তার পরবর্তী রাজা গোবিন্দ চন্দ্র (১০২০-১০৪৫খ্রিঃ)। চন্দ্র বংশের সবচেয়ে প্রতিপত্তিশালী রাজা হিসেবে গোবিন্দ চন্দ্র ইতিহাস খ্যাত। তিনি চোল রাজ রাজেন্দ্র চোলের কাছে পরাজিত হলে দক্ষিণ অঞ্চলের শাসন ভার চলে যায় পাল বংশের হাতে।
একাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে পাল রাজারা দাপটের সাথে দক্ষিণ অঞ্চলে নিজেদের শাসন কাজ পরিচালনা করেন মহীপাল (৯৯৫-১০৪৫), তৃতীয় বিগ্রহ পাল (১০৫৮-১০৭৫), দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭৫-১০৮০খ্রিঃ), রামপাল (১০৮২-১১২৪ খ্রিঃ) প্রমুখ। পাল রাজাগণ ছিলেন ইতিহাসখ্যাত নৃপতি। ইতিহাস খ্যাত কৈবতর্ক বিদ্রোহ হয়েছিল একাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে। রামপাল এ সময়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। কৈবর্ত বিদ্রোহের ফলে দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গে উত্থান ঘটে বর্মদের। এ বংশের খ্যাত পুরুষ ব্রজবর্ম। পরে তাঁর পুত্র জাতবর্ম বহু যুদ্ধে জয়লাভ করে সার্বভৌমত্ব অর্জন করেন। কলচুরি রাজকর্ণের একখানি শিলালিপিতে (১০৪৮-১০৪৯ খ্রিঃ) উল্লিখিত আছে জাতবর্ম খুলনা জেলাসহ দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় চন্দ্র বংশের রাজাকে ধ্বংস করেন। জাতবর্ম কেবলমাত্র নিজের বাহুবলে অঙ্গ কামরূপ ও বরেন্দ্রে স্বীয় প্রাধান্য স্থাপন করে খুলনা জেলাসহ দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বর্ম বংশের অপরাপর শাসকরা হলেন-হরিবর্ম, সালবর্ম, ভোজবর্ম প্রমুখ। বঙ্গে বর্ম পরবর্তী রাজত্ব শুরু সেন বংশের। সেন বংশের আবির্ভাব সম্পর্কে ইতিহাস দৃঢ় কোন তথ্য দিতে পারে না। এ বংশের তৃতীয় নৃপতি বিজয় সেনের আমলটি খ্যাত একটি সময়। তাঁর শাসনামল ছিল ১০৯৭ থেকে ১১৬০ খ্রিঃ পর্যন্ত। তিনি খণ্ড বিভাজন শোষণ ব্যবস্থার আওতায় এনে প্রচলন করেছিলেন কেন্দ্রীয় শাসন। Succeeded in supplanting the Varmans from the south-eastern Bengal and the pales from the north and north-western Bengal. Thus Vijay Sena had established the rule of the Senas over the whole of Bengal. বিজয় সেন ছিলেন শৈব। এছাড়া সেন আমলের যে শিলালিপি ও ফলক পাওয়া গেছে তা থেকে জানা যায় এঁরা ছিলেন চন্দ্র বংশীয় ব্রহ্ম ও ক্ষত্রিয়। বিজয় সেনের পুত্র বল্লাল সেন (১১৬০-১১৭৮ খ্রিঃ) সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বাগড়ি নামক এলাকায় প্রশাসনিক বিভাগ সুদৃঢ় করেন। বাগড়ি অঞ্চলের পরিচয় ও উৎপত্তি বিষয়ে জানা যায়- "উপবঙ্গ নদী ও জঙ্গলে সমাচ্ছন্ন ছিল। বোধ হয় বাগুরি বা বাউরি জাতির নামানুসারে বাগড়ি নাম হইয়াছে। উপবঙ্গের গঠন-কালে বারংবার আগ্রেয় উৎপাত ঘটিয়াছিল। কলিকাতা অঞ্চল খনন করিয়া দেখা গিয়াছে, সে প্রদেশের অরণ্য, অরণ্য-জন্তুসহ বারংবার বসিয়া গিয়াছিল। বঙ্গ ও উপবঙ্গ, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনাদ (মেঘনা) ও গঙ্গার ব-দ্বীপে গঠিত। রাঢ়, বরেন্দ্র, বঙ্গ ও মিথিলা পূর্ব হইতেই ধন-জন-পরিপূর্ণ ছিল; কিন্তু বাগড়িতে মনুষ্যের বাস ছিল না। এই স্থান সমূদ্র গর্ভ হইতে মস্তক উত্তোলন করিতেছিল। আকবরনামায় ইহার ভাটিনাম দেখা যায়। বাগড়ির দৈর্ঘ্য ৫৫০ মাইল ও বিস্তার ৩১২ মাইল। পূর্ব-বিক্রমপুর পদ্মার দক্ষিণে ছিল; যখন ধলেশ্বরী দিয়া পদ্মা প্রবাহিত হইত, অতএব বিক্রমপুর পূর্বে বাগড়ির অন্তর্গত ছিল। এখন ইহা বঙ্গের অন্তর্গত হইয়াছে। বাগড়ির এই অংশই প্রাচীন সমতট"। রজনীকান্ত বাগড়ি অঞ্চলের যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে তিনি এ অঞ্চলকে মোট ১০টি ভাগে ভাগ করেছেন। এগুলো হলো- ১. অন্ধ্রদ্বীপ ২. সূর্যদ্বীপ ৩. মধ্যদ্বীপ ৪. জয়দ্বীপ ৫. চক্রদ্বীপ ৬. কুশদ্বীপ ৭. এডুদ্বীপ ৮. প্রবালদ্বীপ ৯. চন্দ্রদ্বীপ ১০. বৃদ্ধদ্বীপ। বল্লাল সেন ছিলেন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি। বৃদ্ধ বয়সে তিনি পুত্র লক্ষ্মণ সেনের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে মহাদীক্ষায় দীক্ষিত হন। অদ্ভুতসাগর এর একটি তথ্যানুযায়ী বল্লাল সেন শেষ বয়সে সস্ত্রীক ত্রিবেনীর নিকট গঙ্গা তীরে বানপ্রস্ত অবলম্বন করে অতিবাহিত করেছিলেন। এর অন্য অর্থও করা যায় যে, বৃদ্ধ রাজা ও রাণী স্বেচ্ছায় গঙ্গাগর্ভে দেহত্যাগ করেছিলেন। লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বের শেষ আমলে রাজ্যে দেখা যায় নানা রকম অরাজকতা। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী বলতে গেলে কোন রকম বাধা ছাড়াই অধিকার করেন বাংলা। এ ঘটনার পরও প্রায় দু্ বছর জীবিত ছিলেন লক্ষণ সেন। বখতিয়ার খিলজীর আক্রমণের পর তিনি নদীয়া থেকে নৌকাযোগে পালিয়ে যায় বিক্রমপুরে। স্থানীয় প্রভাবশালী কোমল পাল নামে একজন নৃপতি লক্ষণ সেনের রাজত্বকালে খুব সম্ভবত খুলনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অধিকার করেন। বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয়ের সূত্র ধরেই বাংলায় মুসলিম রাজত্বের ভিত্তি স্থাপিত হয়। তবে এ অঞ্চলে মুসলিম শাসন সুদৃঢ় হতে আরো একশত বছরের মতো সময় লাগে। বখতিয়ার পরবর্তী শাসক আল মর্দান খিলজী (১২১০-১২১২খ্রিঃ) ও গিয়াসউদ্দিন ইওজ খিলজী (১২১২-২৭ খ্রিঃ) দু’শাসকই কর গ্রহণ করতেন রাজাদের কাছ থেকে। ফলে বলা যায় এ সময় পর্যন্ত সাতক্ষীরা-খুলনা অঞ্চল পুরোপুরি মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এর পরের ২৮ বছর (১২২৭-১২৫৫ খ্রিঃ) এ অঞ্চলের ইতিহাস কোলাহলপূর্ণ। কিছুদিন সমগ্র বাংলা পরিণত হয় একটা প্রদেশে, আবার মুগিসউদ্দীন ইওজবেক এর নেতৃত্বে বাংলা ভোগ করে স্বাধীনতা। গিয়াসউদ্দিন বলবনের শাসনামলে সুন্দরবনসহ বেশ কিছু অঞ্চল তাঁর অধিকারে আসে। তিনি প্রথমে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা আক্রমণ করে অধিকার করেন এবং সোনারগাঁও অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেন। এ সময়ে চন্দ্রদ্বীপের (বরিশাল) রাজা ছিলেন কায়স্থ নৃপতি দশরথ দনুজমর্দন দেব।
মুঘল আমলে ছবি বুঘরা খান (১২৮১-১২৮৭ খিঃ) রুকনউদ্দিন কায়কাউস (১৩০০ খ্র্র্রিঃ) এর সময়ে সাতক্ষীরা অঞ্চল তাঁদের অধিকারে ছিল কিনা তার সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে ইতিহাসের তথ্যানুযায়ী সামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা জয় করেন। ফলে বলা যায় সাতক্ষীরা অঞ্চল তাঁর রাজ্যসীমার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফখরউদ্দিন মোবারক শাহ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ১৩৩৯ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন শাসসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ। তাঁর সময় থেকে সাতক্ষীরা অঞ্চল চলে যায় শাহী বংশের অধীনে। ১৩৯৯ থেকে ১৪১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সাতক্ষীরা অঞ্চল ছিল ইলিয়াস শাহের বংশের অধীনে। ১৪১২-১৪৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার সিংহাসন অর্ন্তদ্বন্দ্বে পূর্ণ। ১৪৪২ সালে শাহীবংশের নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ সিংহাসনে বসেন। দক্ষিণ বঙ্গের মুকুটহীন সম্রাট হিসেবে যিনি খ্যাত তিনি খানজাহান আলী। এই দরবেশ সেনা দক্ষিণবঙ্গ জয় করেন ১৪৪২ খ্রিস্টাব্দে। কথিত আছে যে, তিনি বাংলার সুলতান নাসিরউদ্দিন শাহের নিকট থেকে একটি সনদে সুন্দরবন থেকে ভূমি পুনরুদ্ধার করে জনপদ সৃষ্ঠি করার অধিকার লাভ করেন।
মুঘল আমলে ছবি নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের পরবর্তী সময়ে হোসেন শাহী নসরত শাহের সময়েও সাতক্ষীরা ছিল তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত। কররানী বংশ প্রতিষ্ঠত হয় ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে। নানা কারণে এ বংশের শাসকেরা ইতিহাসে বিখ্যাত। কররানী বংশের পারিবারিক দ্বন্দ্ব ইতিহাসের আলোচিত অধ্যায়। তাজখান এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা শাসক। তাজখান, তার ভ্রাতা সুলেমান খানের রাজত্বকালে তেমন উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্য না থাকলেও সুলেমান খানের দ্বিতীয় পুত্র দাউদখান কররানী এ বংশের আলোচিত শাসক। মাত্র তিন বছরের শাসনামলে (১৫৭৩-১৫৭৬ খ্রিঃ) তিনি অনেক নিকট আত্মীয়কে হত্যা করেন।
মুঘল আমলে ছবি ঘোড়শ শতকের শেষের দিকে বাংলায় আবির্ভাব হয় বারো ভূঁইয়াদের। কররানী বংশের পতনের পর দক্ষিণাঞ্চলের ভূঁইয়া হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে শ্রীহরি নামের এক ব্রাহ্মণের। তিনি ছিলেন দাউদ কররানীর প্রধান পরামর্শদাতা। শ্রীহরি সুন্দরবন অভ্যন্তরে মকুন্দপুর নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেন ও বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করেন। পরে রাজধানী স্থানান্তরিত হয় ধুমঘাট। তাঁর মুত্যুর পর পুত্র প্রতাপাদিত্য রাজ্য সম্প্রসারণে সচেষ্ঠ হন। তিনি কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা ও পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে একটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন। প্রতাপাদিত্য ছিলেন সমৃদ্ধশালী ও ক্ষমতাঘর শাসক। বাংলার জমিদারদের মধ্যে প্রতাপাদিত্যই সর্বপ্রথম মুঘলদের আনুকুল্য লাভের জন্য ইসলাম খান এর নিকট দূত প্রেরণ করেন এবং পরে ব্যক্তিগতভাবে মুবহদার এর নিকট আনুগত্য প্রদর্শন করেন। পরে প্রতিশ্রুতি ভাঙার কারণে প্রতাপ বাহিনীর সাথে দুটো যুদ্ধ হয় মোঘল বাহনীর। প্রথম যুদ্ধটি হয় সালকা নামক স্থানে ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে। এ যুদ্ধে প্রতাপের পক্ষে নেতৃত্ব দেন তাঁর জৌষ্ঠপুত্র উদয়াদিত্য ও মোঘলবাহিনীর পক্ষে নেত্রত্ব দেন জামাল খান। মোঘল বাহিনীর সাথে প্রতাপাদিত্যের দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় কাগারঘাট ও যমুনার সঙ্গমস্থলে ১৬১২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। এ যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন গিয়াস খানের কিনট। তাঁর শেষ জীবন সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে আছে ভিন্ন ভিন্ন মত। ‘মোঘল বাহিনীর হাতে বন্দী হওয়ার পর সম্ভবত বন্দি অবস্থায় দিল্লি যাওয়ার পথে বেনারসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন’। প্রতাপাদিত্যের পতনের পর খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চল চলে যায় জমিদারদের নিয়ন্ত্রণে। খান-ই-আজম মির্জা আজিজ কোকা (১৮৮২-১৮৮৩ খ্রিঃ) প্রতাপের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের পুরস্কারস্বরূপ মোঘলদের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন আমিদপুর, সৈয়দপুর, মুগদাগাছা ও মল্লিকপুরের জমিদারি। এ সময়ে দক্ষিণাঞ্চলে উল্লেখযোগ্য অপরাপর জমিদাররা হলেন ভবেশ্বর রায়, মাহতাব রায় (১৫৮৮-১৬১৯ খ্রিঃ), কন্দর্প রায়, মনোহর রায় (১৬৪০-১৭০৫ খ্রিঃ) ও শ্রীকৃষ্ণ রায় (১৭০৫-১৭৭২ খ্রিঃ)। সুন্দরবন, সাতক্ষীরা অঞ্চলে প্রতাপাদিত্যের পর ব্যাপক প্রশাসনিক উন্নতি হয় হেংকেলের আন্তরিকতায়। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে টিলম্যান হেংকেল প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট ও জজ নিযুক্ত হন যশোর অঞ্চলে। ঐ বছরেই যশোরে প্রথম আদালত স্থাপিত হয়। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি খুঁটি দিয়ে সীমানা চিহ্নিত করেন। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে যশোর পৃথক জেলার মর্যাদা পায়। এরপর থেকে যশোর অঞ্চল প্রশাসনিকভাবে বিকেন্দ্রীকরণ হতে থাকে। সাতক্ষীরা অঞ্চল মহকুমার মর্যাদা পায় ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে। মহকুমার মর্যাদা পাওয়ার পর প্রথমে সাতক্ষীরাকে যুক্ত করা হয় নদীয়া জেলার সাথে। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে নদীয়া থেকে সাতক্ষীরাকে বিভক্ত করা হয় চব্বিশ পরগণার সাথে। খুলনা জেলার মর্যাদা পায় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে। জেলার মর্যাদা পাওয়ার পর লর্ড রিপনের (১৮৮০-৮৪) আন্তরিক প্রচেষ্টায় সাতক্ষীরা মহকুমাকে খুলনা জেলার একটা মহকুমায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের আওতায় সাতক্ষীরা মহকুমা বাংলাদেশের ৬৪ জেলার একটি জেলা হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। বর্তমানে এ জেলায় ৭টি উপজেলা, ৮টি থানা, ৭৮টি ইউনিয়ন, ৯৬০টি মৌজা, ১৪২১টি গ্রাম ও ২টি পৌরসভা। অবস্থানগত দিক দিয়ে দেখলে সাতক্ষীরা জেলার অবস্থান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানায়। জেলার উত্তর গোলার্ধে নিরক্ষ রেখা এবং কর্কটক্রান্তি রেখার মধ্যবর্তী ২১°৩৬´ থেকে ২১°৫৪´ উত্তর অক্ষাংশে এবং ৮৮°৫৪´ থেকে ৮৯°২০´ দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। উচ্চতার দিকে বিবেচনা করলে এ অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক ১৬ ফুট উচুঁতে। জেলার সীমানা যেভাবে নির্ধারিত হয়েছে তাতে উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ। বর্তমানে এ জেলার আয়তন ৩৮৫৮.৩৩ বর্গ কিলোমিটার। তবে এ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সব অংশে জনবসতি নেই। এর মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ বনাঞ্চল। সুন্দরবনের মধ্যে যে পরিমাণ ভূমি তার পরিমাণ ১৪৪৫.১৮ বর্গ কিলোমিটার। ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক দিয়ে তাকালে এ জেলার পূর্বে খুলনা জেলা, পশ্চিমে চব্বিশ পরগণা জেলার (ভারত) বসিরহাট মহকুমা, উত্তরে যশোর জেলা ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। সাতক্ষীরা জেলার ভূ-প্রকৃতির অধিকাংশই সমতল, অল্প কিছু ভূমি অসমতল। জেলার ভূ-প্রকৃতিকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করেছেন ভূ-প্রকৃতিবিদগণ। এগুলো- ১) গাঙ্গেয় পলল ভূমি ২) মিশ্র গাঙ্গেয় পলল ভূমি এবং ৩) গাঙ্গেয় কটাল পলল ভূমি। জেলার মাটির গঠন প্রকৃতি উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে দু’রকমের উঁচু। এখানে সাধারণত শস্যের ফলন ভাল হয়। দক্ষিণাঞ্চলের মাটি লোনা ও এঁটেল। সমুদ্রের সাথে এ অঞ্চলের নদীগুলোর সরাসরি সম্পৃক্ততার কারণে নদীগুলো বয়ে আনে লবণাক্ত পানি। জোয়ার ভাটার কারণে এই লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয় দক্ষিণাঞ্চলের জনপদ। এ অংশে শস্যের ফলন অপেক্ষাকৃত কম। বর্তমান ভেড়ীবাঁধ দিয়ে ব্যাপক হারে মাছের চাষ করা হচ্ছে। উল্লিখিত দু’প্রকারের ভূমি ছাড়াও সাতক্ষীরা জেলায় নিম্নাঞ্চল জোয়ারের পানি বিধৌত হওয়ার কারণে বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি ও ক্ষয়ের প্রক্রিয়া সচল। এই প্রেক্ষিতে দক্ষিণাঞ্চলে নদীর পলি ও পচনযুক্ত কালো উদ্ভিদের সংমিশ্রণে এক প্রকার মাটি সৃষ্টি হয়েছে। এর নাম জোব মাটি। বিশেষ উন্নত অবস্থায় পৌছানোর পর এ মাটিতে ভাল ফসল জন্মে। সাতক্ষীরা জেলার জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ুর অন্তর্ভূক্ত। এখানে শীতকালে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ও গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রচুর মৌসুমী বায়ু প্রবাহিত হয়। মৌসুমী বায়ুর কারণে জেলায় বৃষ্টিপাতের হার অপেক্ষাকৃত অধিক। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নানা ধর্মাবলম্বী, নানা পেশার, নানা ভাষার লোক বিভিন্ন সময়ে সাতক্ষীরা নামের জনপদে তাদের বসত গেড়েছেন। সঙ্গত কারণেই তাদের কিছু কীর্তির ধ্বংসাবশেষ এখনও আছে এখানে। সংরক্ষণের অভাব, ঐতিহাসিক নিদর্শন ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার, লবণাক্ত আবহাওয়া, ধ্বংস ইত্যাদি কারণে বহু প্রাচীন নিদর্শন আজ বিস্মৃতির অতলে, তবু এখনো যে নিদর্শনসমূহ টিকে আছে তা দেখে ও তার ইতিহাস ঘেটে নির্দ্বিধায় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, বাংলাদেশ তথা বিশ্বের প্রাচীনতম নিদর্শনসমূহের পাশাপাশি অতি সহজেই এ প্রাচীন কীর্তিসমূহ স্থান লাভের যোগ্য।
অর্থনীতি
সাতক্ষীরা প্রধানত চিংড়ির জন্য বিখ্যাত। এখানের চিংড়ি পৃথিবীর অনেক জায়গায় রপ্তানি করা হয়ে থাকে। সাতক্ষীরার সন্দেশ অনেক নামকরা। এছারা সাতক্ষীরা আম এবং মাছের জন্য বিখ্যাত। সাতক্ষীরার মাছ ও আম বাংলাদেশের অনেক জেলায় পউছে দেওয়া হয়। সাতক্ষীরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্তপুরন অবদান রাখছে। অনেক বইদেশিক মুদ্রা অরজন করে জেলাটি অনেক অবদান রেখে চলেছে।
চিত্তাকর্ষক স্থান
সাতক্ষীরার অপার সৌন্দর্যের আধার হচ্ছে সুন্দরবন যা বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য হিসেবে পরিচিত। এ জেলার এক তৃতীয়াংশ সুন্দরবন(১৪৪৫.১৮বর্গকিমি),যা জেলার মোট আয়তনের ৩৭.৫৩%। এছাড়া বর্তমানে মজাফফর গার্ডেন নামে একটি পার্ক বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দেশের অনেক লোক প্রতিদিন এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে ভিড় জমায়।
সাতক্ষীরার ভাষা (উপভাষা) ঃ সাতক্ষীরার ভাষা ইন্দো ইউরোপীয় মূলভাষা হতে উদ্ভূত মাগধী প্রাকৃত (ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়) মতান্তরে গৌড়ী প্রাকৃত (ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ) হতে বাংলাভাষার আধুনিক রূপ। উপমহাদেশীয় ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে সমগ্র বাংলাভাষী অঞ্চল পাঁচটা উপ অথ্চলে বিভক্ত। বৃহত্তর যশোর ও খুলনা জেলাকে উক্ত পঞ্চবিভাজনের মধ্যে বাঙ্গালী উপভাষা অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বৃহত্তর যশোর, খুলনা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা (অবিভক্ত) জেলার দক্ষিণাঞ্চল বাঙ্গালী ও রাঢ়ী উপ ভাষার মিশ্রণে এর নবতর ভাষারূপের সমাহার। ভারতের কোলকাতা রাঢ়ী উপভাষার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ও মানচলিত ভাষা একই রীতির অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এবং সাতক্ষীরা জেলা কোলকাতার সন্নিকটস্থ বলে সন্ধি এলাকার অবস্থাানের কারণে এই মিশ্র বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠায় একে "সুন্দরবনী উপভাষা" নামে অভিহিত করা হয়েছে। (সাতক্ষীরার উপভাষা স্বরূপ ও স্বতন্ত্র; কাজী মুহম্মদ অলিউল্লাহ : ১২২, ২০০৯)। সাতক্ষীরার উপভাষায় রাঢ়ী ও বঙ্গালী রীতির সাধারণ ও মিশ্র বৈশিষ্ট ঃ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সাতক্ষীরার উপভাষা মূলত বঙ্গালী উপভাষার অন্তর্ভুক্ত হলেও অবস্থানগত করাণে অবিমিশ্র বঙ্গালী বৈশিষ্টসমূহ সাতক্ষীরার কথা ভাষায় পুরোপুরি রক্ষিত নেই। তাছাড়া নানাবিধ কারণে উপভাষার বৃহত্তর পরিমণ্ডলের ভেতর সর্বত্র একই রীতি নিখুঁতভাবে বজায় থাকেনা। আঞ্চলিক বৈশিষ্টের দিক দিয়ে যশোর জেলার ওপর রাঢ়ী প্রভাব অপেক্ষাকৃত বেশি, খুলনা জেলার ওপর সেক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম এবং ফরিদপুরের ওপর আরো কম এবং বৃহত্তর খুলনা জেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও অবস্থানগত কারণে সাতক্ষীরা জেলার ওপর রাঢ়ী উপভাষার প্রভাব যশোরের থেকেও অপেক্ষাকৃত বেশি, বিশেষত দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে। সাতক্ষীরার উপভাষায় বঙ্গালী ও রাঢ়ী বৈশিষ্ট কতোটা ও কী পরিমাণ বিদ্যমান তার কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট উল্লেখিত হ’লো- ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট ঃ ১. বঙ্গালী উপভাষার প্রধান বৈশিষ্ট হ’লো ক্রিয়াপদে অপিনিহিত উচ্চারণ বৈশিষ্ট। সাতক্ষীরা রউপভাষায় অপিনিহিতির ই বা উ আগম (বিপর্যাস) আছে ঠিকই, কিন্তু অক্ষত অবস্থায় নেই। এখানে ই বা উ ধ্বনির আংশিক পরিবর্তন ঘটেছে। আর এই পরিবর্তন রাঢ়ী প্রভাবান্বিত- যেমন- রাঢ়ীর মানচলিত রীতি- চলছে, চলেছে, চলেছিলো। বঙ্গালী রীতি- চোইলতে আছে/চোইলতাছে, চোইলাছে, চোইলতেছিলো। সাতক্ষীরার উপভাষা ঃ চোইলতেচে, চোইলেচে/ চোই লেচ্্ চোই লোলো। লক্ষনীয় যে, রাঢ়ীর আগম ই ধ্বনি এখানে অর্ধলুপ্ত। ২. বঙ্গালী উপভাষায় উ আগম অপিনিহিতি রূপে পুরোপুরি ব্যবহৃত। যেমন- যাউকগিয়া, মাউরা, কাউল্যা ইত্যাদি। রাঢ়ী বা মান চলিতে- যাগ্গে মেড়ো, কে’লো ইত্যাদি। সাতক্ষীরার উপভাষায় শ্বদ মধ্যসি'ত আগম উ দ্ভনির বিলোপ ঘটেছে, তবে সেখানে অর্ধ ই (আগম) ক্ষতিপূরণ রূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন- জাই গ্গে / মেই ড়ো, কেই লো ইত্যাদি। ৩. বঙ্গালী উপখাশায় শব্দের আদিতে এ ধ্বনির এ্যা / অ্যা প্রবণতা একটা গুরুত্বপূর্ণ উচ্চারণ রীতি। সাতক্ষীরার উপভাষায় সেটা সর্বত্র ব্যবহৃত হয় না। অনভিজাত, গ্রাম্য অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিতদের মধ্যে এবং বিশেষ ক’রে সুন্দরবন সন্নিহিত এলাকায় এই রীতি বজায় থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ জাতীয় এ্যা ধ্বনি ব্যবহৃত হয় না। বরং শিক্ষিত, অনভিজাতদের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা ঘটে। যেমন- রাড়ী/মান চলিত- তেল, বেল, বেতন, বেদনা এবং ইত্যাদি। রঙ্গালী রীতিতে- ত্যাল, ব্যাল, ব্যাতোন, ব্যাদোনা, এ্যাবোং ইত্যাদি। সাতক্ষীরার উপভাষায় দু’টোই রক্ষিত। তবে মানচলিতের রীতিটা সাধারণত শিক্ষিত, অভিজাত শ্রেণি ও শহরাঞ্চলে প্রযুক্ত হ’য়ে থাকে। পক্ষান্তরে অশিক্ষিত ও গ্রাম্য উচ্চারণে ঠিক তার উল্টোটা ব্যবহৃত হয়। যেম তেল>ত্যাল হয়। ব্যালা>বে-লা ইত্যাদি হয়। অর্থাৎ বঙ্গালী প্রভাব পুরোপুরি মুক্ত নয়। ৪. বঙ্গালী অঞ্জল ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, নোয়াখলি প্রভৃতি এলাকায় আদ্য ও দ্বনি উ ধ্বণিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু এই রীতি সাতক্ষীরার উপভাষা সর্বত্র প্রচলিত নেই। জেলার প্রান্ত শ্যামনগর, সাতক্ষীরা সদর, কলারোয়া, তালা ও প্রান্ত আশাশুনি (খুলনা জেলা সংলগ্ন) উপজেলাতে এই রীতি প্রচলিত থাকলেও অন্যত্র নেই। যেমন- রাঢ়ী বা মানচলিত- ওদের, তোদের, তোমরা, হেলো ইত্যাদি। সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ সংলগ্ন শ্যামনগর, দেবহাটা ও আশাশুনি উপজেলা এবং শিক্ষিতদের মধ্যে এই রীতি প্রচলিত। কিন্তু ওপরে উল্লেখিত উপজেলতে উইগের, তুইগের, তুমার, হুইলো ব্যবহৃত হয়। উক্ত চারটে শব্দের প্রথম দুটোতে উ + ই (অর্ধ) অর্থাৎ ও > উই এবং শেষের দুটোতে ও > উ ব্যবহৃত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ধরনের উচ্চারণপ্রবণতা লক্ষ করা গেলেও প্রান্ত চব্বিশ পরগণা (প. বাংলা. ভারত)- সংলগ্ন উপজেলাতে রাঢ়ী প্রভাবে মানচলিত রীতিই ব্যবহৃত হ’য়ে থাকে। পূর্ব ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে আদ্য উ ধ্বনি ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। উল্লেখ্য যে, প্রথম দুটো শব্দ ওদের ও তোমার রাঢ়ী প্রভাবে যে সব এলাকায় আদ্য ও রক্ষিত সেখানে ওরগা/ওগা, তোরগা/তোগা ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ শুধু আদ্য ও টুকুই রক্ষিত। কিন্তু পরবর্তী ধ্বনি দের (বহুবচন) বঙ্গালী রীতি গের-এর বিপর্যাস ঘটেছে। যেমন- (দের>) গের>রগে (বিপর্যাস)>রগ্না>(এ>আ)গা(মধ্য’র ধ্বনি লোপ) অর্থাৎ তোদের>তোরগা/তোগা। ৫. অ/আদ্য আ-অন-ক ধ্বনিরূপে ফ. ভ মহাপ্রাণ বর্ণের উচ্চারণে বঙ্গালীতে অল্পপ্রাণিভবন ঘটে। যথা- ভয়>বয়, ঘাট>গাট, কফ>কপ ইত্যাদি। কিন্তু সাতক্ষীরারা উপভায় রাঢ়ী বা মান চলিত রীতিতেই ব্যবহৃত হয়। তবে খুলনা জেলা সংলগ্ন তালা উপজেলায় অনেকের উচ্চারণে বঙ্গালী রীতির টান লক্ষ করা যায়। ৬. বঙ্গালী উপভাষায় তাড়ন জাতীয় মূর্ধন্য স্বল্পপ্রাণ বা মহাপ্রাণ ধ্বণি ড়. ঢ় এর কোনে উচ্চারণ নেই। সে ক্ষেত্রে শুধু তাড়ন জাতীয় দন্তধ্বনি পার্শ্বিকধ্বনি র’ উচ্চারিত হয়। সাতক্ষীরার উপভাষাতে এ দুটো রাঢ়ী’র মতোই যথাযথভাবে উচ্চারিত হ’য়ে থাকে। শুধু তালা উপজেলার প্রান্ত খুলনা জেলাসংলগ্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে বঙ্গালী রীতির মতো র ধ্বনি উচ্চারিত হবার প্রবণতা বিদ্যমান। যেমন- বর (বড়)। ৭. বঙ্গালী উপভাষার প্রধান বৈশিষ্ট অপিনিহিতি, আর রাঢ়ী প্রধান বৈশিষ্ট অভিশ্রুতি ও স্বরসংগতি। যেমন- ক. অভিশ্রুতি- ক’রে, দে’খে, রক্ষে, ভাগ্য ইত্যাদি। অথচ বঙ্গালীতে (অপিনিহিতি) ঃ কোইর্যা, দেইখ্যা, রোইক্ষ্যা, ভাইগো ইত্যাদি। খ. স্বরসংগতি- সাধুরীতি- দেখিয়াছিল। বঙ্গালীরীতি- দেইখ্যাছিল। রাঢ়ী বা মানচলিত রীতি- দেখেছিল (দেখে= স্বরসংগতি)। সাতক্ষীরার উপভাষা- দে/দিইকোলো। অর্থাৎ- মাচভা বা রাঢ়ী- দেখেছিল (দ+এ+খ+এ+ছ+ই+ল+ও) সাউভা-দে/দিইকোলা (দ+এই+ক(অল্পপ্রাণিভবন)+ও+(ছ+ই(লাপ)ল+ও)। সাধুরীতি- মরিয়াছি রাঢ়ী বা মানচলিত রীতি- মেরেছি (মেরে-স্বরসংগতি) বঙ্গালী রীতি-মাইরাছি সাতক্ষীরার উপভাষা- মারিচি (রিচি = স্বরসংগতি)। ৮. আদ্যক্ষর বা আদ্যধ্বনিতে শ্বাসাঘাত পড়া এবং পড়ার কারণে পরবর্তী শব্দ মধ্যে বা অনে- অল্পপ্রাণিভবন ঘটা রাঢ়ী রীতির একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট যেটা বঙ্গালীতে বিরণ ক্ষেত্র ছাড়া দেখা যায় না। এই বৈশিষ্টটা সাতক্ষীরার উপভাষায় ব্যাপকভাবে লক্ষিত। যেমন- মধু>মোদু, কাঁঠাল>কাঁটাল, সুখ>শুক ইত্যাদি। বঙ্গালীতে মধ্য ও অন- ধ্বনিতে সাধারণত মহাপ্রাণধ্বনি ব্যবহৃত হ’য়ে থাকে। ৯. রাঢ়ী উপভাষায় কখনো কখনো সন্ধিজনিত কারণে, কখনো কারণ ছাড়াই অঘোষ ধ্বনি ঘোষবৎ উচ্চারিত হয়। যেমন-সন্ধিঘটিত- বটগাছ>বড্গাজ, পাঁচ ভরি> পাঁজ ভোরি ইত্যাদি। এখানে পরবর্তী ঘোষধ্বনির প্রভাবে পূর্ববর্তী অঘোষে সমিভবন ঘটেছে। অর্থাৎ = ট+গ>ড+গ, চ+ভ>জ+ভ>জ+ব হয়েছে। কারণ ছাড়া (বিষমিভবনে) ঃ কাক>কাগ, শাক>শাগ, ফুপু>ফুবু ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে, সাতক্ষীরার উপভাষায় এই ঘোষধ্বনির অঘোষ উচ্চারণ একটা স্বাভাবিক বৈশিষ্ট। মূলত গ্রাম উচ্চারণে এই বৈশিষ্ট ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়। যেমন ঃ খবর>খপোর, গরিব>গোরিপ, আসবে>আশপে, বাবা>বাপা, শাবা>শাপা, বাবু>বাপু, শাবল>শাপোল ইত্যাদি। ১০. রাঢ়ী উপভাষায় অ পরবর্তী ই বা উ ধ্বনি থাকলে আদ্য অ ধ্বনি এর উচ্চারণ ও হয়ে যায়, কিন' উপসর্গ অ এর উচ্চারণ অবিকৃত থাকে। যেমন ঃ অতি>ওতি (অ পরবর্তী ই থাকায় ও তে রূপানি-রিত)। অবিচার>অবিচার (রাঢ়ীতে আদ্য অ উপসর্গ হওয়ায় অ ধ্বনি অবিকৃত)। কিন্তু বঙ্গালীতে ওবিছার, ওশুখ, ওনীল হয়ে যায়। অর্থাৎ আদ্য অ উপসর্গের ক্ষেত্রে অ ধ্বনি অবিকৃত থাকে না। সাতক্ষীরার উপভাষায় এক্ষেত্রে রাঢ়ী রীতিটাই ব্যবহৃত হ’য়ে অবিচার, অশুক, অনিল হয়। ১১. বঙ্গালী উপভাষায় পদমধ্যসি'ত শ, স প্রবৃতি উষ্ম শিষ্ দ্বনি হ তে রূপান্তরিত হয়। কখনো কখনো ছ অর্থাৎ অঘোষ মহাপ্রাণ তালব্য ধ্বনিতে পরিণত হয়। যথা- বস>বহো. সে>হে. আসে>আহে, সকল>হগোল ইত্যাদি (ইম্ম শিস ধ্বনি)। সময়>ছোমায়, বিশাল>বিছাল, বাস>বাছ, শ্বাসাঘাত>ছাছাগাত ইত্যাদি (অঘোষ মহাপ্রাণ তালব্য ধ্বনি)। সাতক্ষীরার উপভাষাতে খুলনা জেলা সংলগ্ন তালা বাদে অন্যান্য উপজেলার প্রায় সর্বত্রই শ,স এর সঠিক উচ্চারণ প্রচলিত, যা রাঢ়ী বৈশিষ্টের ফল। তবে শিশু, নারী এবং বিশেষত হিন্দু নারীদের উচ্চারণে ২নং বৈশিষ্ট অর্থাৎ ছ/চ ধ্বনি ব্যবহৃতহবার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ১২. শব্দমধ্যসি'ত ক ধ্বনি বঙ্গালী উপভাষায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে অ ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়। যথা- সকল>শোআল, টাকা>টাআ/টেকা ইত্যাদি। কালিগঞ্জ, শ্যামনগর, দেবহাটা, সাতক্ষীরা সদর ও আশাশুনির প্রায় সর্বত্র এবং যশোর ও খুলনা জেলা সংলগ্ন তালা ও আশাশুনির কিছু এলাকা ছাড়া সর্বত্র শব্দমধ্যসি'ত ক ধ্বনি স্বাভাবিকভাবে উচ্চারিত হয়। ১৩. যশোরসংলগ্ন তালা উপজেলা এবং খুলনাসংলগ্ন আশাশুনি উপজেলার কিছু অংশ বাদে সাতক্ষীরা জেলার সর্বত্রই অসংখ্য শব্দে রাঢ়ী বৈশিষ্টের প্রভাবে স্বতোনাসিক্যভবন ঘটে। যেমন- কাচ>কাঁচ, হাটু>হেঁইটো, ঝাটা>ঝ্যাঁটা, শাকো>শাঁকো, শোডা>শোঁটা ইত্যাদি। ১৪. রাঢ়ীতে উত্তর পুরুষের অতীতকালের ক্রিয়াপদে লুম, লেম, নু ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়্। সাউভাতে সেক্ষেত্রে শুধু লাম এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কিছু অভিবাসীদের উচ্চারণে নু ব্যবহুত হয়্ যেমন- জাবানু, হবানু, খাবানু ইত্যাদি। সাউভাতে ভবিষ্যৎকালে অবশ্য এ্যনে/আ্যান্ ব্যবহৃত হয়। যেমন- হব্যানে/ন্, দ্যাকপানে ইত্যাদি। ১৫. রাঢ়ীতে প্রথম পুরুষের অকর্মক ও সকর্মক উভয় ক্রিয়ার অনে- ল, লে যুক্ত হয়। সাউভাতে অভিজাতদের মধ্যে লে এবং অনভিজাত শ্রেণীর মধ্যে এ্যালে ও ল্যা ব্যবহৃত হয়। যেমন- লেবো, লেইশো, লেচো (অভি) ইত্যাদি। ১৬. কোনো কোনো ক্ষেত্রে বঙ্গালী উপভাষায় কিছু কিছু শব্দে অস্থানে স্বতোনাসিক্যভবন ঘটে। যথা- টাকা>টেআঁ, আমি>আঁই (এখানে ম এর বিকল্পে চন্দ্রবিন্দু (আনুনাসিক) ব্যবহৃত হয়েছে), বই>বোঁই ইত্যাদি। সাতক্ষীরার কোন অঞ্চলে এ জাতীয় উচ্চারণ লক্ষ করা যায়না। ১৭. সাতক্ষীরার উপভাষার শব্দের আদিতে বা মধ্যে হ শিস ধ্বনির যথাযথ প্রয়োগ একটা স্বাভাবিক বৈশিষ্টের অন্তর্ভুক্ত, যা বঙ্গালী উপভাষার রীতি বিরুদ্ধ। সাতক্ষীরার এই বৈশিষ্ট রাঢ়ী প্রভাবের সংঘটিত। কিন্তু কালিগঞ্জ, শ্যামনগর ও শ্যামনগর সংলগ্ন আশাশুনি উপজেলায় এবং বিশেষত অনভিজাত ও অল্পশিক্ষিতদের ভেতর শব্দের আদিতে অ ধ্বনির উচ্চারণে হ ধ্বনি প্রবণতাও একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত। যেমন- এত>হ্যাতো, এখন> হ্যাকোন, অমন> হমোন, অত>হতো, এ্যাতো>হ্যাতো>হেইত্তে, এমনি>হেমনি, একুশ> হেকুশ, এ>হে ইত্যাদি। ১৮. স্বতোনাসিক্যভবন রাঢ়ীর একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট। এর বৈশিষ্ট সাউভার দক্ষিণ পশ্চিম এলাকাকে প্রভাবিত করছে। উত্তর ও উত্তর পূর্ব এলাকায় এই বৈশিষ্ট কোনো প্রভাবিত করতে পারেনি। রূপতাত্বিক বৈশিষ্ট ঃ ১. বঙ্গালী উপভাষায় কর্তৃকারকে (নির্দিষ্ট ও অনির্দিষ্ট কর্তায়) এ/য় বিভক্তি যুক্ত হয়; যথা- রামে কয়, বাবায় বারি নাই ইত্যাদি। কিন্তু সাতক্ষীরার উপভাষায় রাঢ়ী রীতি অনুযায়ী কর্তৃকারকে শূণ্য বিভক্তি প্রযুক্ত হয়। যথা- রাম বলে, বাব বাড়িনি / বাইড়ুনি>বাইন্নি (সমিভবন) ইত্যাদি। ২. বঙ্গালীতে মুখ্য ও গৌণ কর্মে কে স্থলে রে বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। সাতক্ষীরার উপভাষায় এই রে বিভক্তি শব্দান্তে আঞ্চলিক প্রয়োগে অনেক ক্ষেত্রে রি ঘটে থাকে। যেমন- করিম্রি দ্যাও, হরিরি দ্যায় (<দিয়ে আয়) ইত্যাদি। তবে তারে, ওরে, আমারে, হেরে ব্যবহৃত হ’য়ে থাকে। দ্রুত উচ্চারণে রে > র হ’য়ে যায়। এমনকী সমীভবনের ক্ষেত্রে পুরো বিভক্তিটাই লুপ্ত হয়ে যায়। করিমকে বলো > কোরিমির / কোরিমরি বলো। জ্যোতিকে ডাক্্ > জ্যোতিইড্ডাক। হরিকে দিয়ে আয়>হোরিরি দে আয়> হোরিদ্ধ্যায়/ হো / হুইরেদ্দ্যায় ইত্যাদি। এক্ষেত্রে দ্রুত উচ্চারণে জ্যোতিরি > জ্যোতির > জ্যোতিড্ (জ্যোতির) ডাক = অর্থাৎ র+ড = সমীভবনে ডড’) হয়ে যায়। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিভক্তির আর অস্তিত্ব থাকে না। ৩. বঙ্গালীতে অধিকরণে ত বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। যেমন- বারিত্ যামু, ঘোরিত্ কডা বাইজ্ছে/জে ইত্যাদি। সাতক্ষীরার উপভাষায় ত বিভক্তি তি হ’য়ে যায়। আবার গ্রাম্য উচ্চারণে বিপর্যাস ঘটে। যথা- নোদিতি গাধুতি গেলাম। তোগা বাড়িতি কেডা এইয়েচ্রে? ইত্যাদি। দ্রুত উচ্চারণে এই তি (ত+ই) এর বিপর্যাস ঘটে ইত্ (ই+ত্) হয়। অর্থাৎ নোদিত্ গাধুইত্ জাবো/নোদিত্ গা ধুইজ্জাবো (ত+জ=জজ সমীভবন) বাড়িতে> বাড়িইত্ । এখানে ই বিপর্যাসটা শ্রতিধ্বনির মতো উচ্চারিত হয়। ৪. বহুবচনের ক্ষেত্রে বঙ্গালীতে গো এবং রাঢ়ীতে দের ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সাতক্ষীরার উপভাষায় রাঢ়ী’র দের বিভক্তির পরিবর্তিত প্রয়োগ ঘটে। যেমন- ক. মধ্য, উত্তর ও উত্তর-পূর্ব এলাকায় = ইগের (<দের>গের> ইগের) হয়। যথা- আমাইগের, উইগের, আম্্নাইগের ইত্যাদি। খ. দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায়- দের>গের>রগে(বিপর্যাস)>রগা (এ>আ)>গা (দ্রুত উচ্চারণে র’ লোপে ব্যবহৃত হয়)। যথা- আমরগা, তোরগা, আপ/মোনারগা, তাগা, তোগা, আমাগা ইত্যাদি। তবে সাতক্ষীরার সর্বত্র অশিক্ষিত বা অনভিজাত গ্রাম্য উচ্চারণে উত্তম ও মধ্যম পুরুষে সঙকুচিত হ’য়ে আঙ্গা, তোঙ্গা ব্যবহৃত হয়। ৫. রাঢ়ীতে সাধারণ বর্তমানের রূপ বঙ্গালীতে ঘটমান বর্তমানের রূপে ব্যবহৃত হয়। যথা- মা ডাকে (রাঢ়ী রীতি= সাধারণ বর্তমান)। মায়ে ডাকে (বঙ্গালী রীতি ঘটমান বর্তমান)। কিন্তু সাউভাতে ঘটমান বর্তমানে মা ডেইক্তেচে/চ্ ব্যবহৃত হয়। ঘটমান বর্তমানের ক্ষেত্রে এখানে ভগ্ন অপিনিহিত ব্যবহৃত হ’য়ে থাকে। অর্থাৎ রাঢ়ী বঙ্গালীর মিশ্রণ রীতির মতো ব্যবহৃত হয়। ৬. রাঢ়ীতে ঘটমান বর্তমানের বিভক্তি বঙ্গালীতে পুরাঘটিত বর্তমানের রূপে ব্যবহৃত হয়। যথা- বঙ্গালী- আমি/আঁই করশি/কশ্শি (পরাঘাটিত বর্তমান = করছি)। রাঢ়ী- আমি করছি (ঘটমান বর্তমান)। সাতক্ষীরার উপভাষা- আমি কোত্তিচি/কোত্তিচ্ (ঘটমান বর্তমান) এখানে- ৭. বঙ্গালীতে সাধারণ ভবিষ্যৎ কালের মধ্যম পুরুষে বা এবং রাঢ়ীতে বে ব্যবহৃত হয়। যথা- বঙ্গালী- তুমি যাইবা, দেইখ্বা, বোইল্বা ইত্যাদি। রাঢ়ী- হুমি যাবে, দেখবে, ব’লবে ইত্যাদি। কিন্তু সাতক্ষীরার উপভাষায় বঙ্গালী রীতি অনুযায়ী অনে- বা ব্যবহৃত হ’লেও রাঢ়ী প্রভাবে মধ্যবর্তী ই ধ্বনির লোপ ঘটে। যথা- তুমি জাবা, দ্যাকপা (<দেখবা), বলবা ইত্যাদি। ৮. উত্তম পুরুষের সাধারণ ভবিষ্যৎ কালে বঙ্গালীতে কোথাও মু তাম কোথাও আম বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। যেমন ঃ ক. আঁই/আমি যামু না। খ. আমি/আঁই যাইতাম না। গ. আমি/আঁই যাইয়াম না। তবে বৃহত্তর নোয়াখালিতে আঁই জাইতেন্ ন/নো হয় (ম+ন>ন্ন)। কিন্তু রাঢ়ীতে ব বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। এবং ব>বো হয়। যথা- আমি যা না/যাবোনা। সাতক্ষীরার উপভাষাতেও আমি জাবোনা ব্যবহৃত হয়। ৯. রাঢ়ীতে অতীত কালের ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত নঞ্র্থক অব্যয়ের ক্ষেত্রে নেই, নি এবং বঙ্গালীতে নাই ব্যবহৃত হয়। সাতক্ষীরা উপভাষাতেও নি ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া রাঢ়ীতে যে সব জায়গায় নেই এবং বঙ্গালীতে নাই ব্যবহৃত হয়- সাতক্ষীরাতে সেখানে নি ব্যবহৃত হয়। যথা- ক. লতা বাড়ি নেই = রাঢ়ী খ. লতা বারি নাই = চঙ্গালী গ. লোতা/নোতা/নতা/লতা বাড়ি নি/বাইড়্নি (বিপর্যাস অর্ধ’ই)/বাইন্নি (ড়+ন=ন্ন=সমিভবন) হয়। ১০. অসমাপিকা ক্রিয়ার ক্ষেত্রে। ক. রাঢ়ী- দিয়ে = আমি দিয়ে দিয়েছি। খ. বঙ্গালী- দিয়্যা = আমি / আঁই দিইয়্যা দিছি। গ. সাতক্ষীরা উপভাষায় দে = আমি দে দিচি/চ্। এখানে দে <দিয়ে (রাঢ়ী’ প্রভাব), দিচি< দিছি (বঙ্গালী প্রভাব এবং অনে- চ’ অল্পপ্রাণিভবন রাঢ়ী বৈশিষ্ট। দিচ্ < দিচি (দ্রুত উচ্চারণে অন- ই লোপ)। এরূপ ধ্বনি সংকোচন প্রায়শ ঘটে থাকে। ১১. তুম’ র্থক অসমাপিকা ক্রিয়াপদে- ক. বঙ্গালী- তা’ / তে বিভক্তি = যাইতে/যাইতা, কোইর্তা/কইর্তে ইত্যাদি। খ. রাঢ়ী- তে = স্বরসঙ্গতি রূপে = যেতে, খেতে, বলতে। গ. সাতক্ষীরার উপভাষায়- জাতি, খাতি, বোল্তি ইত্যাদি। এই বৈশিষ্ট বৃহত্তর যশোর, খুলনা ও চব্বিশ পরগণার দক্ষিণাঞ্চলের বহু জায়গায় ব্যবহৃত হয়। ১২. শুধু অসমাপিকা ক্রিয়া নয় শব্দানে- ই’র প্রয়োগ সাতক্ষীরার উপভাষায় নানাভাবে ঘ’টে থাকে। যেমন- ক. সপ্তমী বিভক্তিতে - নাতি, জাতি, বোল্তি ইত্যাদি । খ. ষষ্ঠী বিভক্তিতে - মান্শির (মানুষের), পুতির (পুতের), শালিকির(শালিকের), বিলির(বেড়ালের) ইত্যাদি । গ. অতীত কালের ‘ল’ প্রত্যয়ে - দিলি, গে/গিলি, চোল্লি, কো’লি(কইলে) ইত্যাদি । ঘ. পুরাঘটিত অতীতে - পোড়িচি(পেড়েছি), বোলিচি(বলেছি), হাঁশিচি(হেসেছি), দেকিচি(দেখেছি) । উল্লেখ্য যে, এসব ক্ষেত্রে দ্রুত উচ্চারণে সাতক্ষীরার উপভাষায় অন- ‘ই’ লোপ পায় । যেমন - গিচ্, চোলিচ্, হাঁ/হাশিচ্ ইত্যাদি । ঙ. ক্ষুদ্রাকৃতি ও গুটি অর্থে - লেদি/নেদি, খেঁদি, কোচি (ছোট মেয়েকে সম্বোধন), আবড়ি/ আউড়ি (গোলার মতো বৃহৎ ধান রাখার পাত্র) ইত্যাদি । চ. ঝোঁক ও গুরুত্ব প্রদানে - গেলি,আলি (এলি),বোল্লি, শুন্লি, দেক্লি ইত্যাদি । ছ. নিম্নধ্বনি উচ্চারণে - বোল্তি (বলতে), খাতি (খেতে), কোতি (কইতে) ইত্যাদি । জ. স্বরসাম্যে - দি (<দিই), নি(<নেই) ইত্যাদি । সবশেষে বলা যায়, সাতক্ষীরা জেলা মূলত বৃহত্তর বঙ্গালী উপভাষা অঞ্চল ও রীতির আওতাভুক্ত । কিন্তু প্রান্তরাঢীয় এলাকায় অবস্থানের কারণে ‘রাঢ়ী’ প্রভাবে স্থানীয় বঙ্গালী রীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে । ফলে, বঙ্গালী ও রাঢ়ী রীতির মিশ্রণে সাতক্ষীরার উপভাষায় মিশ্রবৈশিষ্ট গ’ড়ে উঠেছে । সাতক্ষীরার উপভাষার আঞ্চলিক পরিধি সাতক্ষীরার আঞ্চলিক বৈশিষ্টগুলোকে নিম্নোক্তভাবে এলাকাভিত্তিক ভাগ করা যেতে পারে- ১. উত্তর ও উত্তর পূর্ব - যশোর জেলাসংলগ্ন তালা ও কলারোয়া উপজেলা এবং খুলনা জেলা সংলগ্ন তালা ও আশাশুনি উপজেলা । ২. মধ্য- সাতক্ষীরা সদর উপজেলা ও তৎসংলগ্ন তালা, কলারোয়া, আশাশুনি ও দেবহাটা উপজেলা । ৩. দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম - কালিগঞ্জ, শ্যামনগর, কালিগঞ্জ ও দেবহাটা উপজেলাসংলগ্ন আশাশুনি ও দক্ষিণ-চব্বিশ পরগণা/পশ্চিম বাংলা, ভারত সংলগ্ন দেবহাটা উপজেলা । মধ্যাঞ্চলে সাতক্ষীরা জেলা শহর অবস্থিত । নাগরিক জীবন-যাত্রা এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি,রাজনীতি, অফিস-আদালত ও সর্বপ্রকার প্রতিষ্ঠানিক সুযোগ সুবিধের কারণে মানচলিতের প্রভার লক্ষ করা যায় । এ বৈশিষ্ট মূলত বাহ্যিক ও কৃত্রিম ; সামগ্রিকভাবে তা আঞ্চলিক ভাষাকে প্রভাবিত করতে পারেনি । তা ছাড়া সামাজিক প্রয়োজনে এখানে যে মানচলিত ভাষা ব্যবহার করা হয়, উচ্চারণে তাতে ঔপভাষিক বৈশিষ্ট (টান) বজায় থাকে । সামগ্রিকভাবে মধ্যাঞ্চলের ভাষায় ঔপভাষিক বৈশিষ্টই বিরাজিত । এছাড়া থানা সদরগুলো উপজেলায় রুপান্তরিত হওয়ায় - যাতায়াত ব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি ও নানা প্রকার গণমাধ্যম সুবিধের কারণে উপজেলা সদর ও শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কথায় মানচলিতের কিছু প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে ; যদিও তা বাহ্যিক এবং আঞ্চলিক বৈশিষ্ট ও উচ্চারণরীতি মুক্ত নয় । দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের প্রান্তদিক্ষণ সীমা সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলা । প্রান্ত সুন্দরবন এলাকায় বৃটিশ আমলে আদিবাসী অভিবাসন ঘটায় এখানকার কথ্যভাষায় কিছু কিছু আদিবাসী শব্দের প্রভাব ও উচ্চারণ রীতি বিদ্যমান । তবে, সামগ্রিকভাবে শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, দেবহাটা ও কালিগঞ্জ-দেবহাটা সংলগ্ন আশাশুনি উপজেলা পার্শ্ববর্তী জেলা চব্বিশ পরগণা ( পশ্চিম বাংলা, ভারত) তথা মানচলিতের প্রভার অপেক্ষাকৃত বেশি । উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চল খুলনা জেলা সংলগ্ন তালা ও আশাশুনি উপজেলায় খুলনা , ফরিদপুর ও বরিশাল জেলার কিছুটা ভাষিক প্রভাব লক্ষ করা যায় । অন্যদিকে যশোর জেলা তালা ও কলারোয়া উপজেলায় ‘যশুরে’ ভাষার প্রভাব বেশি । তবে সামগ্রিক বিচারে তিন অঞ্চলের কথ্য ভাষায় পারস্পরিত ভিন্নতা ও স্থানিক বৈশিষ্ট নিতান্তই সামান্য । এই উপভাষার সাথে প্রধানত যশোর এবং মোটামুটি চব্বিশ পরগণার (দক্ষিণাংশ, পবঙ্গ, ভারত) ও খুলনা জেলার ঔপভাষিক বৈশিষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ ।
আনুষঙ্গিক নিবন্ধ
দক্ষিণ বাংলার প্রাচীন জনপদ সাতক্ষীরা । পলি সঞ্চিত বিস্তৃর্ণ সমতল উর্বর ভূমি, বন-বনানী শোভিত -লিলায়িত ভঙ্গির অনবদ্য ছবির মতো ইতিহাস ভূগোলের নৃতত্বের ত্রিবেনী সঙ্গমে গড়া গাঙ্গেয় বদ্বীপের বাঘ্রতটটি সাহিত্য ও সাহিত্য প্রেমিকদের স্বর্ণভূমি । এ অঞ্চলের সাহিত্য চর্চার ইতিহাসটি অনেক পুরাতন ফরাসি গবেষক সিলভী লেডির মতে মাননাথ বা মৎসেন্দ্রনাথ এই অঞ্চলের অধিবাসি । চর্চাপদের এই পদক্তাতে এই অঞ্চলের সাহিত্যের আদিম দেবতা মনে করা যায় । ১২শ শতকের দিকে বিশাল আর্থতার সংস্কৃতির উত্তরাধিকার হিসেবে বিচিত্র ধর্মবোধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মোর্গী সম্প্রদায়ের মধ্যে শিব গাজনের পালকারবৃন্দের আর্বিভাব এই অঞ্চলের প্রাচীনত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে । এই সময়ে যোগেন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ, শ্রী কালিপ্রসাদ, হরিপদ নাথ পরবর্তীতে বিধুভূষণদেব বর্মন প্রমূখ এ ধারায় সাহিত্য চর্চা করেন । এদের মধ্যে যোগেন্দ্রনাথের রাধাকৃষ্ণের দ্বন্দ্ব, প্রমিলার আক্ষেপ, সিন্দুবধ, সাবিত্রী সত্যবান প্রভৃতি পালা ও কাহিনীকাব্যকে শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন উচ্চ মূল্যের সাহিত্যকর্ম মনে করেন ।
শ্রীচৈতন্যদেবের বৈষ্ণব ধর্ম আশ্রিত কবি যবন হরিদাস ১৩ শতকে কবিতা চর্চায় বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন । ১৫ শ শতকে বসন্ত রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বৈষ্ণব পদকর্তা কবি গোবিন্দদাসের কবিতা চর্চা করার নিদর্শন পাওয়া যায় । প্রতাপাতিদ্যের রাজসভায় আবলম্ব সরস্বতী ও তার ভাই ডিম ডিম সরস্বতির সাহিত্য চর্চা করার কথা সতীশ মিত্র তার যশোর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থ উল্লেখ করেছেন । কিন্তু সাহিত্য চর্চার এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকার চিহ্ন খুজে পাওয়া যায় না । বরং দীর্ঘ বিরতিতে দেখা যায় বাংলা গদ্য চর্চার দ্বিতীয়ধাপে অর্থাৎ ১৮ শতকের মধ্যভাগে সাতক্ষীরার বেশ কয়েকজন সাহিত্যিক নিষ্ঠার সাথে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন । গবেষক কাজী মোহাম্মদ অলিউল্লাহর মতে ১৮৬১ সালে সাতক্ষীরার প্রশাসনিক পরিবর্তন বিশেষ করে মহকুমার রুপান্তর । পি এ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, ১৮৬৩ সালে সাতক্ষীরার প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট নবাব আব্দুল লতিফ কর্তৃক মুসলিম সাহিত্য সমাজ গঠন, ১৮৮৫ সালে ভারতীয় কংগ্রেসের আত্মপ্রকাশ, এতদাঞ্চলের মানুষদের সাথে কলকাতা কেন্দ্রিক মূলধারায় অধিক সম্পৃক্ততা ইত্যাদি কারণে মূলত এই সময়ে সাহিত্য চর্চার বিকাশ ঘটতে শুরু করে । এই সময়ে যারা সাহিত্য ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন তাদের মধ্যে ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায় (১৮৫১-১৯০৩), খানসাহেব আব্দুল ওয়ালী (১৮৫৫-১৯২৬), আজিজুননেছা খাতুন (১৮৬৪-১৯৪০), খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ (১৮৭৩-১৯৬৫), মুন্সী জিন্নাতুল্লাহ আনসারী (১৮৭৬-১৯৬৫), মাওলানা আহমদ আলী (১৮৮২-১৯৭৭), মাওলানা ফয়েজ উদ্দীন হামিদী (১৮৯৫-১৯৭০), মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী(১৮৯৬-১৯৫৪), মোহাম্মদ আফিলউদ্দীন আহমদ(১৯১৫-১৯৬৫) প্রমুখ প্রধান । প্রাবন্ধিক গাজী আজিজুর রহমানের মতে এরা মূলত সবাই ধর্মকে বিষয় হিসেবে বেছে নিয়ে তার চর্চা ও অনুশীলনে নিমহিত ছিলেন এবং একমাত্র মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী এই অশৈল্পিক ভার থেকে সাতক্ষীরার সাহিত্যকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন । লক্ষনীয় এরা মূলত গদ্যচর্চা করেছেন এবং এদের মধ্যে ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়, খানসাহেব, আব্দুল ওয়ালী ও আজিজুননেছা খাতুনের গদ্য চর্চার পাশাপাশি কাব্যচর্চাও করেছেন । আজিজুননেছা খাতুন সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে প্রথম মুসলিম কবি ও অনুবাদিকা ।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর একই সাথে কলকাতা ও ঢাকা কেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চার দ্বিমুখী স্রোতের প্রভাবে সাতক্ষীরার সাহিত্য একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের চিহ্ন বুকে ধারণ করে অগ্রসর হতে থাকে । উনিশ শতকের ধারাবাহিকতায় আব্দুল ওহাব সিদ্দিকী (১৯০১-১৯৮৫) অধ্যাপক শ্রী নিবাস ভট্টাচার্য (১৯২৭-) অশোক কুমার ভঞ্জ চৌধুরী (১৯২৪-) ডাঃ আহসান উল্লাহ (১৯২৩-) ............উদ্দীন খাঁ (১৯৩০-১৯৯৫) মুল্লুক চাঁদ গাজী (১৯২৮ আনুমানিক) মোহাম্মদ ইউনুস (১৯২৮ আনুমানিক) প্রমুখ সাহিত্য চর্চার ধারা অব্যাহত রাখেন ।
এই দুই পর্বের দু’জন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক হচ্ছেন মোবারক আলী খান (১৮৮৮-১৯৭১) এবং সিকান্দার আবু জাফর (১৯১৮-১৯৭৫) । মোবারক আলী খানের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হচ্ছে বাংলা সনের জন্ম কথা । তার পান্ডিত্য, বিজ্ঞান মনস্ক অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং তাঁর সমকালের তুলনায় অগ্রসর চিন্তার কারণে তিনি বিশেষভাবে খ্যাতিমান হয়ে আছেন ।
সিকান্দার আবু জাফর এদেশের সাংবাদিকা, সাহিত্যসাধনা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক । সমকাল সম্পাদনা তার অন্যতম প্রদান সাহিত্যকৃর্তি ।
৬০এর দশক সাতক্ষীরায় সাহিত্যে পালা বদলের কাল । গদ্য-পদ্য দু’ধারায় অসংখ্য সাহিত্যিকের পদচারণায় মুখর এই সময়ে অনেকের খ্যাতি সাতক্ষীরায় সীমিত পরিসর জাতীয় পর্যায়েও পরিব্যক্ত হয় । এ সময়ের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মীরা হলেন শেখ মোহাম্মদ কওছার আলী (১৯১৯-১৯৯১), আনিছ সিদ্দিকী (১৯৩৪-১৯৮৫), আবুল কালাম মহিউদ্দিন (১৯৩৪), এখলাস উদ্দীন সরকার(১৯৩৪), শেখ শামসুর রহমান(১৯৩৬-১৯৯৫), ড. মোমেন চৌধুরী (১৯৩৬-২০০৮), আল কামাল আবুল ওহাব(১৯৩৮-২০০৮), তবিবুর রহমান(১৯৩৮-১৯৮৪), শাহেদা খানম(১৯৩৮-২০০৭), আ স ম বাবর আলী (১৯৪২), আবু জাফর (১৯৪২), গোলাম মঈনউদ্দীন (১৯৪৪), আজমল হক প্রমূখ ।
বাঙালির মহত্তম অর্জন সমূহের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা অন্যতম । স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সাতক্ষীরার সাহিত্য পত্রপুষ্পে সুশোভিত হয়ে সাতক্ষীরা সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে । ৬০ এর দশকে সাহিত্য চর্চা শুরু করলেও পরবর্তী সময়ে সময়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন । এমন বেশ কয়েকজন সাহিত্যিক স্থানীয় আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন । এরকম কয়েকজন হলেন খায়রুল বাসার (১৯৪৮), গোলাম সরদার সিদ্দিকী, হাসান আব্দুল খালেক(১৯৪০), তৃপ্তি মোহন মল্লিক(১৯৪৩), গাজী আজিজুর রহমান, আফজালুল বাসার(১৯৫৭), ইয়াসমিন জাহান শাহীন প্রমুখ ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, উল্লেখিতদের মধ্যে ড. মোমেন চৌধুরী গবেষণায় , আনিস সিদ্দিকী ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস রচণায়, আল কামাল আব্দুল ওহাব ও তবিবুর রহমান শিশু সাহিত্যে বিশেষভাবে অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন ।
দীর্ঘদিন ধরে সাতক্ষীরায় গবেষনার মতো একটি শ্রমসাধ্য বিষয়ের চর্চা ও প্রবন্ধ সাহিত্য নিয়ে কাজ করছেন কাজী মুহম্মদ অলিউল্লাহ । ইতিমধ্যে তার উপভাষা গবেষণা বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার পন্ডিতমহলে সমাদৃত হয়েছে ।
গত শতকের শেষ দুই দশক এবং এ শতকের ১ম দশক হচ্ছে সাহিত্যিক বৃত্ত থেকে ছড়িয়ে পড়ার কাল । এককভাবে কেহ সাহিত্যের চূড়াস্পর্শ করতে না পারলেও এই সময়ের নিরলস সাহিত্য কর্মীরা সাতক্ষীরা সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ও বগেবান করে তুলতে উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে চলেছে । এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন সাহিত্যকর্মী হচ্ছেন মুফতি আব্দুর রহিম, ড. মিজানুর রহমান, আফজাল হোসেন, আব্দুল কাদিম, অধ্যাপক মোঃ আবু নাসের, আব্দুল ওহাজ আজাদ, আতা রহমান, আবুল হোসেন আজাদ, সিরাজুল ইসলাম, পল্টু বাসার, শেখ নজরুল ইসলাম, গাজী শাহজাহান সিরাজ, সালেহা আখতার, শুভ্র আহমেদ, আবু সুফিয়ান সজল, মনিরুজ্জামান ছট্টু, ইমরুল ইউসূফ, নরেন্দ্র সুগন্ধ্যা, নিশিকান্ত ব্যানার্জী, সঞ্চয় মনির, আহমদ সাব্বীর, নাজমুল হাসান প্রমুখ ।
৬০ এর দশকের বাংলা কবিতা বিষয় ও বিন্যাসে ছিল দ্রোহী । সেই দ্রোহের স্বতন্ত্র ও মূর্ত প্রকাশ ছিলো সিকান্দার আবু জাফর, সাবদার সিদ্দিকি এবং পরবর্তীকালের সুনীল সাইফুল্লাহর মধ্যে । সমগ্রের মধ্যে এক গহন ছুরির মতো প্রবেশের অসাধারণ ক্ষমতা ছিলো শেষোক্ত দু’জনের ।
তথ্য সুত্র :
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে